সুন্দরবনে নৌকো বিহার, রয়্যাল বেঙ্গল সাফারি এবং ছৌ-নাচের আনন্দ উপভোগ করুন, ৩ দিন ২ রাতের সফরে

Tripoto
Photo of সুন্দরবনে নৌকো বিহার, রয়্যাল বেঙ্গল সাফারি এবং ছৌ-নাচের আনন্দ উপভোগ করুন, ৩ দিন ২ রাতের সফরে 1/1 by Deya Das
সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার (ছবি সংগৃহীত)

আমাদের ভারতবর্ষ একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ | উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, আবার পূর্বে বঙ্গোপসাগর, ব-দ্বীপ অঞ্চল থেকে পশ্চিমে মরুভূমি অঞ্চল গোটা ভারত জুড়েই জলবায়ু, পরিবেশ, প্রকৃতি, মানুষ আর তাদের জীবন যাত্রা সমস্ত কিছুর মধ্যে তারতম্য লক্ষ করা যায় |

সমস্ত ভ্রমণপিপাসু মানুষের গোটা ভারতবর্ষ পর্যবেক্ষণ করার একটা সুপ্ত অভীপ্সা থাকেই, তাই তাদের জন্য সুন্দরবন এবং ব-দ্বীপ অঞ্চল ভ্রমণ এক্কেবারে অন্যরকমের অভিজ্ঞতার আস্বাদ এনে দিতে পারে | সুন্দরবনের গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্য, ব-দ্বীপ অঞ্চল সমৃদ্ধ উদ্ভিদ এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রধান সম্পদ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় গড়ে তুলতে চাইলে একবার সুন্দরবনে অবশ্যই আসতে হবে |

সুন্দরবনের ভৌগোলিক অবস্থান:

ম্যাপের মাধ্যমে সুন্দরবনের অবস্থান (সংগৃহীত)

Photo of Sundarban, West Bengal, India by Deya Das

ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তে অবস্থিত সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্কটি একটি ব- দ্বীপ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে | গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী মিলিত হয়ে যেখানে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়েছে, সেই সংযোগস্থলে এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের উৎপত্তি | এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সুন্দরী গাছের নাম অনুসারেই এই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয় | ম্যানগ্রোভ অরণ্যের খ্যাতনামা গাছগুলো হল সুন্দরী, গড়ান, গেওয়া ইত্যাদি | অন্যদিকে সুন্দরবনের প্রাণীজ সম্পদের জন্য সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্কটি ইউনেস্কোর দ্বারা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমাও পেয়েছে সম্প্রতি|

২০১১ সালে ভারতের গণনা অনুযায়ী সুন্দরবনে মোট ১৮০ টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে তার মধ্যে ভারতে মাত্র ৭৪টি বর্তমান | রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও এখানে কুমির, ঘড়িয়াল, হরিণ ইত্যাদি পশুর সমাবেশ ঘটেছে | এই ম্যানগ্রোভ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় ৭,৯০০ বর্গমিটার, যা বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের আখ্যায় ভূষিত হয়েছে |এর মধ্যে ১৬৪০ বর্গ মিটার ভারতের অন্তর্ভুক্ত, যা পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত |

ভ্রমণবৃত্তান্ত

প্রথম দিন:

কলকাতা থেকে ট্রেন ধরে পৌঁছে যান ক্যানিং স্টেশন| স্টেশন থেকে ১টা ম্যাজিক গাড়ি চেপে ঘণ্টা খানেকের দূরত্বে পৌঁছে যান গদখালী | এই প্রসঙ্গে বলে রাখি সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য আপনারা স্থানীয় টুরিস্ট এজেন্সি অথবা অনলাইন যে কোনও ট্যুর এজেন্সি থেকে আগে থেকে পরিকল্পনা করেও যেতে পারেন | অথবা গদখালী পৌঁছেও আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী সুন্দরবন ভ্রমণের প্ল্যানিং করে নিতে পারেন | তবে আগে থেকে পরিকল্পনা করে, ট্যুরিস্ট এজেন্সির সাহায্যে গেলে নৌকা ভাড়া কম হয় এবং এই বন্যপ্রাণ সুরক্ষিত স্থানটি ভ্রমণের জন্য বনদপ্তর থেকে সহজেই অনুমতি মিলে যায় | গদখালী জায়গাটিকে ছোট্ট বন্দর বললে কিছু ভুল হবে না | গদখালী থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে রাজকীয় নৌকা | সম্পূর্ণ সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য আপনার একমাত্র সঙ্গী হবে এই নৌকা বা বোটটি | নৌকোগুলোতে আপনার জন্য থাকা-খাওয়া বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধার যথেষ্ট বন্দোবস্ত রয়েছে |

বোটের মাধ্যমে সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন (ছবি সংগৃহীত)

Photo of সুন্দরবনে নৌকো বিহার, রয়্যাল বেঙ্গল সাফারি এবং ছৌ-নাচের আনন্দ উপভোগ করুন, ৩ দিন ২ রাতের সফরে by Deya Das

নৌকায় চাপার পরেই আপনার জন্য প্রাতঃরাশ পরিবেশন করে দেবেন নৌকায় থাকা সহকারীবৃন্দ | এই সময়ের মধ্যেই আপনি পৌঁছে গেছেন লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে | আপনার নৌকার চারিদিকে শুধু জল আর জঙ্গল, ও হ্যাঁ! আর সঙ্গে রয়েছে সূর্যমামা | এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতেই পৌঁছে যান আপনার পরবর্তী গন্তব্য গোসাবাতে|

নৌকো থেকে নেমে ঘুরে নিন স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন ও রবীন্দ্রনাথের বাংলোতে | তৎকালীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এই বাংলোটি বেশ সাজানো গোছানো | মজবুত কাঠ দ্বারা নির্মিত এই বাংলোর সম্মুখে রয়েছে অসংখ্য ফুলের বাগান | গোসাবা থেকে নৌকায় উঠেই আপনার জন্য হাজির হয়ে যাবে দ্বিপ্রাহরিক আহার | এবার গন্তব্যস্থল পাখিরালয় | আবার নৌকা রায়মঙ্গল নদী বক্ষে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলবে | চারিদিকে আবারও অসংখ্য জলরাশি, মাঝে মাঝে নদী তীরবর্তী ছোট ছোট গ্রাম দেখতে দেখতে বুঝতেই পারবেন না কখন সূর্য অস্তাচলে চলে গেছে, আর আপনারাও পৌঁছে গেছেন পাখিরালয়ে | সেখানে থেকে পৌঁছে যান আপনার হোটেল | পাখিরালয় গ্রামটি এখানকার অন্য গ্রামের তুলনায় বেশ জনবহুল | ইচ্ছা করলে সন্ধের দিকে গ্রামের চারপাশটা একটু ঘুরে নিতে পারেন | রাত্রে খাবার খেয়ে, নিরালা শান্ত পরিবেশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে নিশ্চিন্তে চলে যান ঘুমের দেশে |

দ্বিতীয় দিন:

সকালে উঠে রেডি হয়ে পৌঁছে যান নদীর তীরে আপনার অপেক্ষমান নৌকোতে | আজকের গন্তব্য হল বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ অরণ্য পর্যবেক্ষণ | প্রাতঃরাশ করতে করতে আপনার বোট ধীরে ধীরে আপনাকে নিয়ে যাবে গভীর অরণ্যের উদ্দেশ্যে| এই যাত্রাপথে প্রথমেই আপনাদের জন্য রয়েছে পাখীর কাকলি, বাদর আর তার মা-এর লুকোচুরি খেলা, পরিযায়ী বক জাতীয় পাখির জল পান করা ইত্যাদি | এই সব দেখতে দেখতেই আপনি পৌঁছে যাবেন আজকের প্রথম গন্তব্য সজনেখালি টাওয়ার | এখানে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ দর্শন হবে লালমুখো হরিণের সঙ্গে | ওয়াচ টাওয়ার থেকে আপনি দেখতে পাবেন চারিদিকে গভীর অরণ্য, জংলী সরীসৃপ, হরিণের দল প্রভৃতি |

প্রকৃতির সংস্পর্শেই কাটবে আপনার পুরো দিনটা (ছবি সংগৃহীত)

Photo of সুন্দরবনে নৌকো বিহার, রয়্যাল বেঙ্গল সাফারি এবং ছৌ-নাচের আনন্দ উপভোগ করুন, ৩ দিন ২ রাতের সফরে by Deya Das

এরপরের গন্তব্যটি হল দোবাঁকি | আবার নৌকাটি ছোট ছোট খাঁড়ি পেড়িয়ে এগিয়ে চলবে সামনের দিকে আরও | এই খাঁড়িগুলোর দুই তীরে আছে লবনাক্ত জলের উপর জীবনধারণের ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যানগ্রোভ অরণ্য | দোবাকি পৌঁছে প্রথমেই দর্শন করে নিন এই অরণ্যের দেবী বনবিবির | টাওয়ার পৌঁছনোর ঠিক আগেই রয়েছে বনবিবির ছোট্ট মন্দির, যেখানে স্থানীয় মানুষ তাঁর নিত্য অর্চনা করেন | কিছু দূর এগোনোর পর টাওয়ার থেকে ঘন অরণ্যটা পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারেন | এই অরণ্যের মধ্যে আপনি দেখা পাবেন হরিণ, বাঁদর, নানান পরিযায়ী পাখি, মাছরাঙা, আর ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই দেখা পেলেও পেতে পারেন সুন্দর বন এর প্রধান সম্পদ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের |

বন্যপ্রাণীর দেখা মিলতে পারে এই সফর পর্বেই (ছবি সংগৃহীত)

Photo of সুন্দরবনে নৌকো বিহার, রয়্যাল বেঙ্গল সাফারি এবং ছৌ-নাচের আনন্দ উপভোগ করুন, ৩ দিন ২ রাতের সফরে by Deya Das

এবার হোটেল ফেরার পালা | দোবাকি থেকে পাখিরালয় ফেরার পথে খাঁড়ির তীরের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আপনি সাক্ষাৎ পেতে পারেন কুমির এবং বিষধর সাপের | এই খাঁড়ির পথ ধরে এগোতে গিয়ে একটা সময় দেখবেন আপনার বোটটি পৌঁছে গেছে মোহনার দিকে | চারিদিকে সুদূর বিস্তৃত জলরাশি আর তার থেকে একটু দূরে বঙ্গোপসাগরের হালকা ঝলক চোখে পরবে|বিকেলের রোদের মলিন আলো মেখে, শীতের ঠান্ডা আমেজ এবং সুন্দরবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসুন হোটেলে | সন্ধেবেলা হোটেলে বনফায়ার এর সাথে আপনার জন্য রয়েছে ছৌ- নৃত্য প্রদর্শন | এখানকার স্থানীয় মানুষ , পর্যটকদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ছৌ - নাচ কে রোজগারের অন্যতম পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন|

তৃতীয় দিন:

তৃতীয় দিনের সফরে আপনি ঘুরে আসতে পারেন ঝড়খালি আইল্যান্ড থেকে| বনদপ্তরের পক্ষ থেকে এখানে পশুদের একটা সেবা কেন্দ্র রয়েছে | দ্বিতীয় দিনে যদি আপনার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখার সুযোগ নাও হয়, তারা অবশ্যই এই সেবা কেন্দ্রে এসে বাঘমামাকে চাক্ষুষ করতে পারবেন |

এবার ফেরার পালা | ঝড়খালি আইল্যান্ড ভ্রমণ করে আপনার বোটে চেপে আবার ফিরে আসুন গদখালীতে |

ভ্রমণের সেরা সময়:

পর্যটকদের মতে সুন্দরবন ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস|

কাদের জন্য উপযুক্ত:

এই ভ্রমণে সব বয়েসের মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারেন | পরিবারের সমস্ত পরিজনের সঙ্গেও বা প্রিয় মানুষের সঙ্গেও যেতে পারেন |

খরচ:

শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং ট্রেন ভাড়া মাথা পিছু ২৫ টাকা মতো | ক্যানিং থেকে গদখালী ম্যাজিক গাড়ির ভাড়া মাথা পিছু ৪০ টাকা | গদখালী থেকে ২ রাত ও ৩ দিনের মাথাপিছু খরচ ৩৫০০ টাকা মতো (থাকা, খাওয়া,সাধারণ হোটেল ভাড়া, নৌকাবিহার সহযোগে ভ্রমণ অন্তর্ভুক্ত )| আপনি আপনার ইচ্ছা অনুসারে, পছন্দ মতো হোটেল ভাড়া করেও যেতে পারেন |

কোথায় থাকবেন :

সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য পাখিরালয় জায়গাটি রাত্রিবাসের জন্য আদর্শ | এখানে ছোট বড় অনেক গুলো হোটেল ও ভিলা রয়েছে | হোটেল এর ভাড়া ৮০০ -১৫ ,৫০০ টাকার মধ্যে উপলদ্ধ আছে |

আহার :

নিরামিষ বা আমিষ আহার আপনি আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী পছন্দ করে নিতে পারেন | খাদ্যরসিক এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষের একমাত্র ডেস্টিনেশন হয়ে উঠতে পারে এই সুন্দরবন |

কীভাবে যাবেন:

ট্রেনে:

ভারতের যে কোনও ছোট বড় শহর থেকে পৌঁছে যান হাওড়া, কলকাতা স্টেশন বা শিয়ালদহ স্টেশনে | হাওড়া এবং কলকাতা স্টেশন পৌঁছলে সেখান থেকে ছোট গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যান শিয়ালদহ স্টেশন | তারপর লোকাল ট্রেন ধরে ঘণ্টা দুয়েক দূরত্বে পৌঁছে যান ক্যানিং স্টেশন | ক্যানিং থেকে ৩০ কিমি দূরত্বে পৌঁছে যান গন্তব্যে |

বিমানে :

ভারতের যে কোনও বিমানবন্দর থেকে পৌঁছে যান কলকাতা বিমানবন্দর | বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে শিয়ালদহ পৌঁছে লোকাল ট্রেনে ক্যানিং পৌঁছতে পারেন | আবার বিমানবন্দর থেকে ছোট গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ১০০ কিমি দূরত্বে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে |

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যাবহার করুন।