বাংলার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির ও জনগোষ্ঠীর মানুষের অবদান রয়েছে। তাঁদের রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং পারিবারিক সংস্কার সৃষ্টি করছে এমন এক আবহ, যেখানে লোকসংস্কৃতি পেয়েছে সাবলীল বহিঃপ্রকাশের সুযোগ। বাংলার বিভিন্ন লোকনৃত্য বা ফোক ডান্সগুলিও সেই সকল মানুষজনের ভাবের বহিঃপ্রকাশ, তাঁদের আনন্দের অবকাশ। পর্যটকদের কাছেও এ এক অনন্য সুযোগ, পশ্চিমবঙ্গের এই স্বল্প পরিচিত শিল্পকলগুলিকে আরও নিবিড়ভাবে চিনে নেওয়ার।
গম্ভীরা নাচ
পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় গেলে দেখতে পাবেন গম্ভীরা নাচ। এক সময়ে কৃষিকার্য সুসম্পন্ন ভাবে যাতে সম্পন্ন হয়, সেই উদ্দ্যেশে এই নাচের আরম্ভ হয়। কালক্রমে তা পরিণত হয়েছে ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক নৃত্যানুষ্ঠানে। দেবীশক্তির পূজার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে এই নাচ। শক্তিদেবীর ভক্তরা এই নাচ আয়োজনের মাধ্যমে দেবী কে খুশি করার চেষ্টা করেন এবং তাঁদের জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করেন।
হারমোনিয়াম, ড্রাম, জুড়ি আর বাঁশির সুরে সুরে শুরু হয় এই নাচ। দুই প্রধান নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে নেচে ওঠেন আরও অনেকে। সবাই মিলে পরে থাকেন চিরাচরিত কিছু মুখোশ, যা এই অনুষ্ঠানে অন্য মাত্রা যোগ করে।
কীর্তন নাচ
ভক্তিযোগের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হল ৫০০ বছর পুরনো এই নৃত্যকলা। কথিত আছে পুরাকালে নারদমুনি স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর নামবন্দনা করতেন কীর্তননাচ পরিবেশনের মাধ্যমে। শ্রীকৃষ্ণের উদ্দ্যেশে দলে দলে ভক্তরা কীর্তন নাচের মাধ্যমে তাঁদের ভক্তি ও প্রেম নিবেদন করতেন এবং তাঁদের ভক্তিগীতিতে প্রসন্ন হলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের স্বয়ং দেখা দিতেন। কীর্তন নাচে রয়েছে নানান রকম সঙ্গীত, মুদ্রা এবং নাটকীয় অনুষঙ্গ। শুধু নৃত্যকলা নয়, যেন ভগবানের কাছে সরাসরি ভক্তের মনের ভাব প্রকাশের এক মাধ্যম এই নাচ।
কুশান লোকনৃত্য
বাংলার আরেক সুপ্রাচীন লোকনৃত্য হল কুশান লোকনৃত্য নামে পরিচিত নৃত্যকলাটি। কুশ মানে খড় এবং আন বলতে নিয়ে আসাকে বোঝানো হয়। কুশান লোকনৃত্যের আরেক বৈশিষ্ট্য হল এটি রামায়ণের কাহিনি হতে অনুপ্রাণিত। মতান্তরে কু মানে খারাপ এবং শান বলতে বিতাড়িত করা বা অবসান করা বোঝানো হচ্ছে মনে করা হয়। সেদিক দিয়ে এই নৃত্যের নামের মানে হয়ে উঠছে অশুভকে বিতাড়নের উদ্দ্যেশে নাচা নৃত্য। নাচটি পরিবেশন করেন পুরুষ নৃত্যশিল্পীরা, এমনকি মহিলা চরিত্রের পোশাক পরে তাঁরাই মহিলা সেজে নাচেন। সঙ্গে থাকে বাঁশি, হারমোনিয়ামের মতো বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গত। পাশে চলে খাঁটি বাংলা ভাষায় নাচটির এবং রামায়ণের বিভিন্ন অংশের ধারাবিবরণী।
অলকাপ নাচ
পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বাংলার আরেক স্বল্প পরিচিত নৃত্যশিল্পের নাম হল অলকাপ নাচ। মূলত মালদা এবং রাজশাহী অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে এই নাচটির প্রচলন দেখা যায়। প্রধানত প্রতি বছর এপ্রিল মাসে গাজন উৎসবের সময় ভগবান শিবের উদ্দ্যেশে এই নাচের আয়োজন করা হয়।
শুধু নাচ নয়, অনুষ্ঠানের অন্তর্গত হয় নানান রকম নাটক, আবৃত্তি এবং সংগীতানুষ্ঠান। নাটক, গান এবং নাচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা জনপ্রিয় প্রেমকাহিনি। সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, নাট্যশিল্পী সবাই মিলে সমগ্র এলাকাবাসীর মনোরঞ্জন যোগান এই বিচিত্রানুষ্ঠানে।
ছৌ নাচ
সম্ভবত গ্রাম বাংলার সবথেকে পরিচিত নাচ এই ছৌ নাচ, পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছৌ নাচ নিয়ে আগ্রহ ছড়িয়ে পড়েছে দেশে, বিদেশে। পুরুলিয়ার এই আদি নৃত্যকলাটি আদিবাসী নৃত্যশিল্পের নিদর্শন, যার সাথে জড়িয়ে আছে মার্শাল আর্টসের বেশ কিছু মুদ্রা ও ভঙ্গিমা। প্রতি বছর চৈত্র মাসে পুরুলিয়ার নানা অংশে ছৌ নাচের আসর বসে। রামায়ণ এবং মহাভারতের নানান পৌরাণিক কাহিনি নৃত্যকলার মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। ছৌ নাচের আর এক বিখ্যাত বৈশিষ্ট্য হল নৃত্যশিল্পীদের দ্বারা ব্যবহৃত বড় বড় রঙচঙে মুখোশ গুলি, যারা বাংলার মুখোশশিল্পের মূর্ত নিদর্শন। বহু শতাব্দী পূর্বে পুরুলিয়াতে এই নাচটির উৎপত্তি হয় এবং কালক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডের নানান অঞ্চলে। তবুও পুরুলিয়ার ছৌ নাচের ধারাটি নিজস্ব স্বাতন্ত্র বজায় রেখে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।