কেদারনাথের ভয়ঙ্কর সেই রাত..........
বছর দশেক আগে সবার মনে আছে নিশ্চয়ই উত্তরাখণ্ডের সেই ভয়াবহ বন্যার কথা। মৃত্যু হয়েছিল কয়েক হাজার তীর্থযাত্রীর। বেশ কয়েক বছর আগে তৈরি হয়েছিল কেদারনাথ মুভি, উত্তরাখণ্ডের বন্যা এ ছবির নেপথ্য কাহিনি। কিন্তু সেই ভয়াবহতা ছাপিয়ে যায় দুই তরুণ ও তরুনীর প্রেম। এ যেন কলেজের দিনগুলিতে প্রেমের মতোই।দুই বিপরীত ধর্মের প্রেম-কাহিনি ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাচ্ছে ছিল ২০১৩ সালের সেই ভয়ঙ্কর রাতে। যে-রাতে পাহাড় ভেঙে জলস্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কেদারনাথ শহরকে, মারা গিয়েছিল বেশ কয়েক হাজারেরও বেশি মানুষ, নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য মানুষ । কি হয়েছিল সেদিন?? আসুন জেনে নেওয়া যাক প্রত্যক্ষদর্শীর সেদিনের তিক্ত ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।15 জুন 2013 থেকে কেদারনাথ উপত্যকায় ভারী বৃষ্টি শুরু হয়। সেখানকার মানুষ এমন বৃষ্টি আগে কখনো দেখেনি। 16 জুনও বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। এই সময়ে, কেদারনাথের চারপাশের পাহাড়ের হ্রদগুলি প্রচুর পরিমাণে জলে ভরে যায় এবং হিমবাহগুলিও গলতে শুরু করে। কেদারনাথে তীর্থযাত্রী, পুরোহিত এবং পুরোহিত সহ অন্যান্য লোকের প্রচুর ভিড় ছিল এবং সবাই বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছিলেন কিন্তু 16 জুন সন্ধ্যায় কী ঘটতে চলেছে তা কেউ জানত না।
কেদারনাথ বসতির আশেপাশে সারা রাত গর্জনে নদী প্রবাহিত হতে থাকে। মানুষ পালানোর পথ খুঁজছিল। প্রত্যেকে এর মধ্যে সেদিন আতঙ্কে ছিল কিন্তু কেদারনাথে আটকে পড়া মানুষগুলো বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিল। সারা রাত একটানা বৃষ্টি হয়। মন্দির, হোটেল, রেস্ট হাউসে জেগে থাকা মানুষগুলো ভাবছিল এখন কী হতে যাচ্ছে কে জানে? হঠাৎ মন্দাকিনীর ভয়ানক গর্জনের মধ্যে চোরাবাড়ী পাথরের বাঁধ বিকট শব্দে ভেঙ্গে পড়ল এবং সর্বনাশ হল। বন্যা এসেছে...বন্যা এসেছে...এই বলে মানুষজন আতঙ্কে ছুটতে লাগল। হ্রদের সমস্ত জল পাথর খন্ড এবং বড় বড় পাথরের সাথে প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়ে কেদারনাথ বসতি , হোটেল, বাড়ি, বিশ্রামাগার, দোকানপাট সব নিমিষেই ধ্বংস করে দিয়েছিল সেদিন এবং শত শত মানুষের মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখে সেদিন কেঁপে উঠেছিল।
মন্দাকিনী উপত্যকায় 16-17 জুন 2013 দিনটি খুব কমই কারও মন থেকে বেরিয়ে আসবে। মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টির কারণে কেদারনাথ মন্দিরের ৫ কিলোমিটার উপরে চৌরাবাড়ি হিমবাহের কাছে একটি বাঁধ তৈরি হয়েছিল, অতিরিক্ত জলের চাপে তা সম্পূর্ন রুপে ভেঙে পড়ে। আর ধ্বংসাবশেষের সাথে সাথে এর সমস্ত জল দ্রুত নেমে আসতে শুরু করে।এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায় সেদিন কেদারনাথ মন্দিরের এক ঘণ্টাকে ধরে সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় জলে ভাসমান মৃতদেহের উপর টানা নয় ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে নিজের জীবন রক্ষা করেছিল।দুর্যোগের পরদিন সকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনি মন্দিরের ঘণ্টার সঙ্গে ঝুলে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের ভারসাম্য রাখতে তিনি মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন। জলের তিব্রতা এতোই ছিল যে তার জামাকাপড় টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল কিন্তু কোনোভাবে সে আশা ছাড়েনি।
তবে সেই রাতে মহাপ্লাবনে মন্দির সহ সবকিছুই গিলে ফেলত, যদি এক অলৌকিক ঘটনা না ঘটতো। সেই দিন মহাদেবের অসীম কৃপা শুধু মহাদেবেরই মন্দির বা কেদারনাথের বিগ্রহ শুধু নয় মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া ৫০০ মানুষের জন্য এটি ছিল এক অলৌকিক ঘটনা। মন্দিরের পিছনে প্রায় 50 ফুট দূরে ধ্বংসস্তূপের সাথে একটি বিশাল ড্রামের মতো পাথর নেমে আসার সময় হঠাৎ থেমে যায়। মন্দিরের ঠিক পিছনে অবস্থিত শিলাটির দিকে তাকালে মনে হয় কেউ এটিকে সেখানে থামিয়ে দিয়েছে। উপরের পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা প্রচন্ড জলের স্রোত এই শিলাকে টলাতে পারেনি। আর ঠিক সেই কারণে এই জলে ধারা পাথরে আছড়ে পড়ে দুই ভাগ হয়ে মন্দিরের দুই পাশ দিয়ে বয়ে যাওযায় মন্দির প্রায় অক্ষত থেকে যায়। সত্যিই এক রহস্যময় ঘটনা। মহা ধ্বংসের সেই বিপর্যয় কেদার উপত্যকার সবকিছু ধ্বংস করে ফেলেছিল কিন্তু পাথরটি মন্দিরটিকে আগলে রেখেছিল। বিপর্যয়ের সময়, এই পাথর খণ্ডটি বন্যার জল এবং তার সাথে আসা বিশাল পাথরগুলিকে থামিয়ে কেদারনাথ মন্দিরকে রক্ষা করেছিল। স্থানীয় লোকজনের মতে, কেদারনাথ মন্দিরটি পাণ্ডবরা তৈরি করেছিলেন। সেই রাতেও মন্দিরকে বাঁচাতে পরাক্রমশালী ভীম মন্দিরের পিছনে একটি পাথরের আকারে তাঁর গদা স্থাপন করেছিলেন। এই কারণে,লোকেরা এই অলৌকিক শিলাকে ভীম শিলা নামে ডাকতে শুরু করেছিল যা মন্দিরটিকে রক্ষা করেছিল এবং এর ভিতরে আশ্রয় নেওয়া লোকদের ও। ভীম শিলার প্রস্থ প্রায় মন্দিরের প্রস্থের সমান, যা সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। আজ সেই ঘটনার ১১ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আদিগুরু শঙ্করাচার্যের সমাধির কাছে মন্দিরের পিছনে অবস্থিত এই পাথরটির রহস্য এখনও রয়ে গেছে যে মন্দিরের প্রস্থের সমান এই পাথর কোথা থেকে এলো এবং হঠাৎ কীভাবে এটি দেখা গেল? যদিও বা এলো তা ও ঠিক মন্দির থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে পড়লো। সত্যিই বিস্ময়কর। যাই হোক না কেন, ভীম শিলা, যিনি সেই রাতে ত্রাণকর্তা হয়েছিলেন, শুধুমাত্র মন্দিরটিকেই রক্ষা করেননি, বাবা কেদারের প্রতি মানুষের অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাকেও বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই কারণেই আজ এই শিলা মানুষের বিশ্বাসের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং লোকেরা এটিকে বাবা কেদারের অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করে এবং পূজা করে।
তবে এই বিপর্যয় বুঝিয়ে দিয়েছিল অস্বাভাবিক বেশি বৃষ্টি এবং হিমবাহ গলা জলে হ্রদে বন্যা মারাত্মক হতে পারে। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস মানুষের আচরণে দেবতারা ক্ষুব্ধ , সেই কারণেই মেঘভাঙা বৃষ্টি - বন্যা কেদারনাথের বিপর্যয় ও মৃত্যুর মূল কারণ। দেবভূমির দেবতারা এখন রেগে গিয়েছে। তাই দেবতারা এখন আশীর্বাদ দেয় না,তার বদলে এখন দেবতারা শাস্তি দিচ্ছে এমন ধারণাটিই পোক্ত হয়েছে মানুষের মনে। মানুষই দূষণ ঘটাচ্ছে যে কারণে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। দেবভূমিকে দেবতাদের অযোগ্য করে তুলেছে মানুষই। তাই আর ক্ষমা নয়, দেবতারা শাস্তি দিতে শুরু করেছেন, বলছেন স্থানীয়রাই। তবে আমরা যদি প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরন করি বা সতর্ক না হই, একদিন যে সব শেষ হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
✍️ কেদারনাথ দর্শনের সময় বেশ কিছু স্থানীয় মানুষের কাছে প্রাপ্ত তথ্যের কৃতজ্ঞতা স্বীকার