মাটির স্বাদে নতুন ধানের গন্ধে গ্রামবাংলার উৎসব-'নবান্ন' সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্যসুন্দর আয়োজন

Tripoto
Photo of মাটির স্বাদে নতুন ধানের গন্ধে গ্রামবাংলার উৎসব-'নবান্ন' সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্যসুন্দর আয়োজন 1/2 by Deya Das
গ্রামীণ লোকাচারের পদ্ধতি (ছবি সংগৃহীত)

কথায় বলে "বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ" আর এই তেরো পার্বণের অন্যতম একটি পার্বণ "নবান্ন উৎসব"।পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বার্ষিক ঋতুকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান নবান্ন। যা প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের 'প্রথম দিন' পালিত হয়। তাই অগ্রহায়ণ মাস এলেই গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে বেজে ওঠে এই উৎসবের পদধ্বনি।

নবান্নের তাৎপর্য:

'নবান্ন' শব্দের অর্থ হল 'নতুন অন্ন'। গ্রাম বাংলায় হেমন্ত ঋতুতে যখন পাকা ধানের সোনালী আভা মাঠের চতুর্দিক মুখরিত করে তোলে, ঠিক সেই সময় নতুন আমন ধানে গোলা ভর্তি হয় কৃষকের। প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ভরে ওঠে নতুন চালের গন্ধে। প্রধানত, নতুন ধান কাটা আর নতুন ধানের অন্ন রান্না এবং পরিবেশনকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই উৎসব। নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা এবং বিভিন্ন প্রাণীকে উৎসর্গ করে অতপর আত্মীয়-স্বজনকে সেই খাবার পরিবেশন করা হয়। কখনো কখনো এই অনুষ্ঠানে বাড়ির জামাই ও মেয়েকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়।

Photo of মাটির স্বাদে নতুন ধানের গন্ধে গ্রামবাংলার উৎসব-'নবান্ন' সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্যসুন্দর আয়োজন 2/2 by Deya Das
মাঠে মাঠে ধান কাটার প্রস্তুতি (ছবি সংগৃহীত)

নবান্নের আনুষ্ঠানিক পর্বের বিবরণ:

অগ্রহায়ণ মাসে অনুষ্ঠিত কৃষিজ ফসল কাটার এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন লৌকিক প্রথা দেখতে পাওয়া যায়। সৃষ্টি হয় এক নতুন আবহের। নতুন ধান কেটে ঘরে ওঠানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে সমস্ত কৃষক পরিবারের লোকেরা। নতুন ধান কাটার পর গ্রাম বাংলার প্রচলিত গানে ঢেঁকির তালে সেই ধান ভাঙ্গা হয়। তারপর সেই নতুন চালের গুঁড়ো সাথে বিভিন্ন রকম শীতকালীন ফল, দুধ,নতুন গুড় এবং সামান্য পরিমাণ আদা মিশিয়ে তৈরি করা হয় এক রকম নৈবেদ্য। যা প্রথমে গৃহে অধিষ্ঠিত লক্ষী নারায়নের সামনে ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয় এবং পরবর্তীতে সেই নৈবেদ্য 'কাকের' সামনে দেওয়া হয়। যা কাকের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে যায় পূর্ব পুরুষদের কাছে। লোকাচার অনুযায়ী, এই প্রথাকে বলা হয় "কাকবলী"। এর সঙ্গেই বাড়ির আঙিনায় আলপনা দেওয়া হয়। এছাড়াও গৃহে আগত অতিথিদের জন্য নতুন চালের ভাত, পঞ্চব্যঞ্জন, নতুন চালের পিঠে, পায়েস, ক্ষীর ইত্যাদি রান্না করে পরিবেশন করা হয়।

নবান্ন সংক্রান্ত আনন্দ উৎসব:

হাজার হাজার বছরের পুরনো এই নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে বড় লক্ষণীয় বিষয় হল অসাম্প্রদায়িকতা। ঐতিহ্যবাহী চিরাচরিত এই গ্রামীণ উৎসব মাটির সাথে কৃষকের আত্মিক মেলবন্ধনের এক অনন্য রূপ। তাই তো

কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বলেছেন -"....হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।"

নবান্ন উৎসবকে ঘিরে প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জের কিছু গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়।যেখানে মনোরঞ্জনের বিষয় হিসেবে সবার প্রথমে থাকে আঞ্চলিক কিছু নাচ গান। এছাড়াও গ্রামের বিভিন্ন হস্তশিল্প এবং এই নতুন ধান দিয়ে তৈরি সুস্বাদু পিঠেপুলি,পায়ের সমস্ত কিছুই এই গ্রামীণ মেলায় বিক্রি করতে দেখা যায়। তাই নবান্ন উৎসবের মেলা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসে। এই গ্রামীণ মেলায় শুধু নবীনরা নয়,সর্বত্র ভাবে প্রবীণরাও অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও মেলার এক প্রান্তে বসে গানের পসরা,যেখানে অঞ্চলভেদে জারি-সারি,মুর্শিদি, লালন এবং বিচার গান পরিবেশিত হয়। ছোটদের জন্য এই মেলায় থাকে সার্কাস,পুতুল নাচ,নাগরদোলা এবং বায়োস্কোপের ব্যবস্থা।

নবান্ন উৎসব পালনের বিশেষ স্থান:

প্রধানত ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে এই 'শস্য- উৎসব'পালন করা হয়। তবে ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরেও'নবান্ন উৎসবের' আনুষ্ঠানিক শুভ সূচনা করা হয়।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে গড়ে ওঠা এই নবান্ন উৎসব বর্তমান যুগে কিছুটা হারিয়েছে তার জৌলুস। শিল্প এবং নগরায়নের করাঘাতে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এই উৎসবের মূলভিত্তি। তাই সর্বস্তরের সর্ব সাধারণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠলে এবং আগ্রহী হলেই; স্থায়িত্ব ঘটবে নবান্ন উৎসবের মতো বেশ কিছু 'গ্রাম বাংলার পুরাতন ঐতিহ্য সমন্বিত' উৎসবগুলির।

কোথায় কোথায় পালিত হয়

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ,বীরভূম, বর্ধমান এবং অগ্রদ্বীপের দোঁয়াশী গ্রাম সহ বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক নবান্ন উৎসব উদযাপিত হয়।

পথনির্দেশিকা

হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল এ করে অগ্রদ্বীপ স্টেশনে নেমে সেখান থেকে অটো বা টোটো করে ১০ মিনিটের পথ গেলেই এই দোঁয়াশী গ্রামের নবান্ন মেলা দেখতে পাওয়া যায়।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যাবহার করুন।