ভারত এবং বাংলাদেশের নতুন বছর উদযাপন এবং রীতিনীতি, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন...

Tripoto
Photo of ভারত এবং বাংলাদেশের নতুন বছর উদযাপন এবং রীতিনীতি, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন... 1/1 by Deya Das

প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই নতুন বছর অনেকটা সদ্যজাত শিশুর মতো; যাকে কেন্দ্র করে অনেক আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা ঘিরে থাকে । নতুন বছরের সূচনা আমাদের সকলকেই নতুন করে বাঁচার সুযোগ এনে দেয় । আপামর বাঙালির কাছে নতুন পোশাক, খাওয়া দাওয়া ছাড়াও বাঙ্গালিয়ানাকে সেলিব্রেট করার জন্য একটা বিশেষ দিন হল নববর্ষ ।

আধুনিক কালে, বাংলার সমস্ত মানুষ বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ হিসেবে পালন করেন । এই বিশেষ দিনটি উদযাপন করার রীতি পশ্চিমবঙ্গে তো রয়েইছে, এছাড়াও ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি রাজ্যে এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও যথেষ্ট আড়ম্বর সহকারে পালন করা হয় ।

চলুন জেনে নেওয়া যাক বৈশাখ মাস তথা নতুন বছরকে ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশে কীভাবে আহ্বান করা হয় ।

ভারতবর্ষ -

পশ্চিমবঙ্গ এর নববর্ষ

Photo of West Bengal, India by Deya Das

বাংলায় বছরের প্রথমদিনটি নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ নামে পরিচিত ।বর্তমানে যে বাংলা ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয় সেটি মূলত সূর্য সিদ্ধান্ত গ্রন্থ অনুসরণ করে নির্মিত এবং তা ভারতীয় রীতিনীতির পরিপূরক । যেহেতু এই ক্যালেন্ডার, হিন্দু ক্যালেন্ডার এর সংমিশ্রনে নির্মিত তাই তাই বছরের প্রথম দিনে হিন্দু রীতিনীতির মতো বাংলাতেও উৎসবের আয়োজন করা হয় ।বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের প্রথম দিনটি এপ্রিল মাসের ১৪ কিংবা ১৫ তারিখে উদযাপন করা হয় ।কিন্তু বাংলায় নববর্ষের উদ্ভব কেন হল? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরে যেতে হবে অতীতে ।

বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রচলন এবং নববর্ষ সূচনার ইতিহাস

বাংলার ইতিহাস থেকে এই নববর্ষ সংক্রান্ত অনেকগুলি তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায় ।

১. মুঘল রাজত্বকালে ইসলামীয় হিজরী অর্থাৎ লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বাংলার মানুষদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হত । কিন্তু এই ক্যালেন্ডারের নতুন বছরের সঙ্গে কৃষিজ চক্রের সামঞ্জস্য ছিল না । আর সেই সামঞ্জস্য রক্ষার কারণেই বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি। আকবর তার রাজসভার জ্যোতির্বিদ ফাদাল্লাহ সিরাজি সহায়তায় লুনার ইসলামীয় ক্যালেন্ডার এবং হিন্দু ক্যালেন্ডারের সংযোগে নির্মাণ করেন ফসলি সন। ঐতিহাসিকদের মতে এই ফসলি সনের হাত ধরেই বাংলা ক্যালেন্ডারের বহিঃপ্রকাশ এবং সেই সময় থেকেই বাংলা বছরগুলি বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত পায় ।

২. ঐতিহাসিকদের আরেকটি তত্ত্ব অনুসারে সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক এর আমল থেকেই বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি । কারণ এই বাংলায় টেরাকোটা শিল্পরীতি অনুসরণ করে বাঁকুড়ায় দুইটি শিব মন্দির রয়েছে যার উৎপত্তি মুঘল সাম্রাজ্য এর আগে এবং এই মন্দিরের শিল্পকার্যে বঙ্গাব্দ শব্দটি নিদর্শন পাওয়া যায় । সুতরাং, বাংলায় মুঘল আমলের পূর্বেই বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রচলিত ছিল মনে করেন কিছু ঐতিহাসিকগণ ।

৩.ক্যালেন্ডার নির্মাণ সম্পর্কিত তৃতীয় তত্ত্বটি হল - গ্রামবাংলার হিন্দু শাস্ত্রবিদদের মতে,বিক্রমাদিত্য ভারত এবং নেপালের মতো বাংলা ক্যালেন্ডার নির্মাণ করেন । এই ক্যালেন্ডারে প্রচলন ঘটে ৫৯৩ সাল থেকে তবে মনে করা হয় ক্যালেন্ডারের সূচনাকালে সময় বা তিথির ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল। আর এই ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসের প্রথম দিনটি আজও সকলের কাছে বিশেষত্বের জায়গা করে নিয়েছে ।

নববর্ষ উদযাপনের রীতি -

নতুন বছরের সূচনার দিনটি বাঙালিদের কাছে শুভদিন হিসেবেই বিবেচিত হয় । অনেক বাঙালির বাড়িতে আলপনা দিয়ে নিষ্ঠার সাহায্যে পূজা সম্পন্ন করে শুভ শক্তির আমন্ত্রণ জানান ।এছাড়াও বছরের প্রথম দিনের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে একটা নতুন আর্থিক বছরের ও সূচনা হয় তাই বিভিন্ন বিপণীতে ভগবান গনেশ এবং দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করে থাকেন । তাই গহনার বিপণী গুলিতে হালখাতার প্রথা রয়েছে । অনেকে গৃহে শুভ শক্তির সঞ্চার ঘটানোর জন্য নতুন বছরের বিশেষদিনে কিছু মূল্যবান জিনিসও কেনেন । প্রথম দিনকে স্মরণীয় করে তোলার জন্য পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সম্পাদন করা হয় ।

পাঞ্জাবের বৈশাখী -

Photo of Punjab, India by Deya Das

পাঞ্জাবে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিতে বৈশাখী উৎসব পালন করা হয় । হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই দিনটি এপ্রিল মাসের ১৪ বা ১৫ তারিখে উদযাপন করা হয় । শিখ সম্প্রদায়ের কাছে এই উৎসবটি ধর্মীয় এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসব।

বৈশাখী উৎসব উদযাপনের ইতিহাস -

শিখ সম্প্রদায়ের ইতিহাসে বৈশাখী উৎসবটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একসময় মুঘল সাম্রাজ্যের রাজা ঔরঙ্গজেব এর আদেশ ছিল সম্পূর্ণ শিখ সম্প্রদায়কে মুসলিম ধর্মে পরিণত করা । কিন্তু সেই সময় শিখদের প্রথম গুরু তেগ বাহাদুর মুসলিম ধর্ম অবলম্বন করতে প্রত্যাখ্যান করেন এবং শিখ ধর্মকে ভারতে কার্যকরী করেন । আর সেই সময় থেকেই বৈশাখী উৎসবটি শিখ ধর্মের প্রবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়। পরবর্তী কালে দশম গুরু গোবিন্দ সিং শিখ সম্প্রদায়ের উদ্ভব কে স্মরণে রেখে খালসা পন্থ এর প্রচলন ঘটান এই বৈশাখী উৎসবের দিনেই ।এছাড়াও জালিওয়ানাবাগ হত্যাকান্ড এই দিনেই ঘটে।তাই পাঞ্জাবের মানুষের কাছে বৈশাখী উৎসবের আনন্দঘন মুহূর্তের মধ্যে কোথাও যেন দুঃখের আভাস লুকিয়ে থাকে ।

বৈশাখী উৎসবের রীতি -

Photo of ভারত এবং বাংলাদেশের নতুন বছর উদযাপন এবং রীতিনীতি, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন... by Deya Das

বৈশাখী উৎসবটি শিখদের নতুন বছর হিসেবে উদযাপিত হয় ।পাঞ্জাব এবং উত্তর ভারতীয় অঞ্চলে এই সময় ফসল কাটার পর পরের বছরের জন্য বীজ বপন করা হয় তাই উৎসবটি ফলন উৎসব নামেও পরিচিত ।যেহেতু এই দিনটি শিখ ধর্ম প্রবর্তনের ও দিন তাই শিখরা বছরের প্রথম দিনটি যে কোনো জলাশয় বা নদীতে স্নান করে গুরুদ্বারা যান এবং শিখদের পবিত্র গ্রন্থ গুরু গ্রন্থসাহেব পাঠ করে দেবতাকে আরাধনা করেন ।

আসামের রঙ্গোলি বিহু -

Photo of Assam, India by Deya Das

আসামেরে নতুন বছরের সূচনার দিনটি রঙ্গোলি বিহু বা বোহাগ বিহু নামে পরিচিত । আসামের ক্যালেন্ডার নির্মিত হয়েছে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ক্যালেন্ডারের সংমিশ্রনে । বিহু উৎসবটি কৃষিকার্য বিশেষত ধান উৎপাদনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । রঙ্গোলি বিহু উৎসবটি এখানে মূলত ফলন উৎসব হিসেবেই পরিচিত ।

বিহু উৎসবের রীতি -

প্রতিবছরের প্রথম দিন অর্থাৎ এপ্রিল মাসের ১৪ বা ১৫তারিখে এই উৎসবের সূচনা হয় । প্রায় ১সপ্তাহ ধরে এই উৎসব আয়োজন করা হয় । দিনটি কে বিশেষভাবে পালন করার জন্য আসামের নানান স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । সুখ সমৃদ্ধির জন্য আসামের প্রতিটি বাড়ির প্রবেশদ্বারে পিতল, কিংবা রুপোর পাত্র সাজিয়ে রাখা হয় । মহিলারা সযত্নে পিঠে জাতীয় মিষ্টান্ন এবং পানীয় তাই -অহম, জলপান ইত্যাদির সাহায্যে অতিথি আপ্যায়ন করেন ।

বিহারের জুর শীতল -

Photo of Bihar, India by Deya Das

বিহারে বিশেষত মৈথিলী সম্প্রদায়ের নতুন বছরের সূচনার দিনটি জুর শীতল নামে পরিচিত । গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মৈথিলী সম্প্রদায়ের নতুন বছরের সূচনার দিন হলো ১৪ই এপ্রিল ।

জুর শীতল উৎসবের রীতি -

বিহারের এও এই উৎসবটি হার্ভেস্ট ফেস্টিভ্যাল হিসেবে পরিচিত । এই পবিত্র দিনে ভগবানের উদ্দেশ্যে কলস স্থাপনার সাহায্যে নতুন দিনের সূচনা হয় । বিহারের মানুষরা এই দিনে ছাতু এবং গুড় খেয়ে ভগবানকে সোনা বা রুপো উৎসর্গ করেন ।

ভারতে উপরিউক্ত রাজ্য গুলি ছাড়াও বৈশাখের প্রথম দিনটি কেরালা, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, তমিলনাড়ু, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, ইত্যাদি রাজ্যে বিশেষভাবে পালিত হয় ।

বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ -

Photo of Bangladesh by Deya Das

প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও পহেলা বৈশাখ আড়ম্বর সহযোগে পালিত হয় । তবে এই উৎসবের মধ্য দিয়ে মুসলিম ধর্মাবলম্বী দেশে হিন্দু এবং মুসলিম একতা বিশেষভাবে নজর কাড়ে ।১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের পাকিস্তানের কঠোর আইনের বিরোধিতা করার জন্যই বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উৎসবের উৎপত্তি ।

পহেলা বৈশাখ উদযাপনের রীতি -

পশ্চিমবঙ্গ এর মতো এখানে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং শোভা যাত্রার আয়োজন করা হয় ।এই বিশেষ দিনে ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ বা যে কোনো শুভ কাজের সূচনা করা হয় । তবে পহেলা বৈশাখ এর দিনে বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িতে পান্তা ভাত এবং ভর্তা সহযোগে ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার রীতি আছে ।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা -

Photo of ভারত এবং বাংলাদেশের নতুন বছর উদযাপন এবং রীতিনীতি, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন... by Deya Das

বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনে অর্থাৎ ১৪ ই এপ্রিল বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস বিভাগের পক্ষ থেকে একটা শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় । এই শোভা যাত্রায় সামিল হন সমস্ত ছাত্র থেকে শিক্ষকগণ । শোভাযাত্রার প্রথম সূচনা হয় ১৯৮৯ সালে যা আজও বাংলাদেশের মানুষের কাছে সমান ভাবে জনপ্রিয় ।২০১৬ সালে এই শোভা যাত্রাটি UNESCO এর দ্বারা 'intangible cultural heritage' এর আখ্যায় ভূষিত হয়েছে ।

শোভাযাত্রা আয়োজনের কারণ -

১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের মিলিটারি শাসন এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই শোভাযাত্রারে আয়োজন শুরু করেন । শোভাযাত্রা মূল উদ্দেশ্য ছিল অশুভকে দমন করা, নিজেদের মনে সাহস জাগানো এবং পরিশেষে দেশে শান্তি বজায় রাখা । এছাড়াও বাংলাদেশের লোকজ রীতি নীতি গুলিকে অক্ষুন্ন রাখা । পরবর্তী কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চিটাগং বিশ্ববিদ্যালয় এ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় ।

মুসলিম ধর্মাবলম্বী দেশের বাঙ্গালীয়ানাকে রক্ষার এই বিশাল আড়ম্বরের সাক্ষী থাকতে হলে যে কোনো বছর পহেলা বৈশাখ পালন করতে পৌঁছে যেতেই পারেন বাংলাদেশে ।

বৈশাখকে আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে সকল পাঠকদের জন্য নতুন বছরের অনেক শুভেচ্ছা ।

শুভ নববর্ষ ।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।