রুই, কাতলা, মৃগেল অথবা পমফ্রেট, চিংড়ি, ইলিশ, বা আড়, চিতল, বোয়াল। নিদেনপক্ষে শিং মাছ, মাগুর। আর সেইসব দিয়ে কখনও ঝাল, কখনও ঝোল, কখনও বা কালিয়া। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের আগাগোড়াই যেন এক আবেগঘন মাছময় এক বিষয়। কিন্তু বর্তমান কালে বাজারে সেই মাছের আয়োজনে অনেকটাই সীমিত পরিসর চোখে পড়ে। কোল্ড স্টোরেজের মাছ, আর রেস্টুরেন্টে ভেটকির নামে বাসা খেয়ে খেয়ে স্বাদেও পড়েছে চড়া। তবে উপায়? বাঙালি কি মাছ না খেয়েই থাকবে? চিন্তা করবেন না, উপায় আছে বটে। হুগলির আদিসপ্তগ্রামে প্রতি বছর হয় মাছের মেলা। হ্যাঁ, হরেক কিসিমের বাছাই মাছের সে এক লোভনীয় সম্ভার। নয় নয় করেও, দেবনন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কৃষ্ণপুরের এই মৎস্যমেলার বয়স প্রায় ৫০০ বছর!!
কীভাবে হয়েছিল মৎস্যমেলার উৎপত্তি
৫০০ বছরের অধিক পুরানো মেলা টিকে থাকার পেছনে কিন্তু লুকিয়ে আছে গ্রামবাংলার ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কথিত আছে প্রাচীনকালে জমিদার গোবর্ধন দাসের পুত্র রঘুনাথ দাস শ্রী চৈতন্যের দর্শনের ইচ্ছায় গৃহছাড়া হন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। বহুবছর পরে, মহাপ্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের পরে তিনি ফিরে আসেন এবং তাঁকে স্বাগত জানাতে কৃষ্ণরামপুরে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়।
কথিত আছে, সেই মেলায় মহাপ্রভুর নামকীর্তনের পাশাপাশি রঘুনাথ স্থানীয় বৈষ্ণবদের পেট পুরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন, এবং জমিদার বাড়ির পুকুর থেকে অসময়েও ইলিশ মাছ ধরে এনে সবাইকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। প্রতি বছর রঘুনাথের মহাপ্রভু দর্শন এবং বৈষ্ণব ভোজনের বর্ষপূরণে নতুন করে আয়োজিত হতে শুরু করে এই মেলা।
যদিও শুরুর দিকে নামগান, কবিগান, নাট্যপালার এবং অন্যান্য সামগ্রী বিক্রির পাশাপাশি মাছ বিক্রিও হত, কালক্রমে মাছ দর্শন-ই যেন হয়ে ওঠে মেলার প্রধান আকর্ষণ। আর মেলাটিও পরিচিত হয়ে ওঠে আদিসপ্তগ্রামের মাছ মেলা নামে।
মাছমেলার অভিজ্ঞতা : কী দেখলাম, কী কিনলাম
বাৎসরিক এই মাছ মেলার প্রধান আকর্ষণ হল বৈচিত্রপূর্ণ নানা রকম মাছের সমাহার, যার মধ্যে পাবেন গ্রাম বাংলার বহু বিরল এবং স্বল্পপরিচিত মাছের সন্ধান, যা আপনি বহু খুঁজলেও গড়িয়াহাট বা মানিকতলার বিখ্যাত মাছের বাজারেও পাবেন না। আর দেখতে পাবেন বিশাল বিশাল ভেটকি, রুই, কাতলা, আড়, গুরজাওলি মাছেদের, যার কোনও কোনওটার ওজন ২০, ৩০ বা এমনকি ৫০ কেজি হওয়ায় আশ্চর্যের বিষয় নয় একেবারেই। নানা রকম ছোট মাছ, পুঁটি, মৌরোলা, ট্যাংরাও পাবেন মন ভরে। দরদাম করে কিনতেও পারবেন, বাড়ি ফিরে রাঁধতে পারবেন মনের মতো করে।
মেলায় কিছু কিছু বিশালবপু মাছ আসে প্রতিবছর, যেগুলোর নিলাম করা হয় হাজার হাজার টাকায়। সবচেয়ে বেশি দাম দিয়ে আপনিও তাই বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন ৪৫কেজির টাটকা টাটকা ভেটকি।
মেলায় দেখতে পাবেন ২০-২৫ টি দোকান, আর মিঠে ও নোনা, দু ধরনের জলের মাছ ও পাবেন, সাম্প্রতিক কালে রে মাছ, টুনা মাছ, কাঁকড়া, ইল জাতীয় মাছও পাওয়া যাচ্ছে।
মাছ মেলা কখন হয় :
প্রতি বছর শীতকালে পয়লা মাঘ (ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি বছর ১৫ বা ১৬ই জানুয়ারি, ২০২১-এ এই মেলা অনুষ্ঠিত হবে ১৫ই জানুয়ারি) এই মেলার আয়োজন করা হয়। শুধুমাত্র ওই একদিন-ই কিন্তু মেলাটিতে এরম মাছের সমারোহ ঘটে। তাই ওইদিন সক্কাল সক্কাল গিয়ে উপস্থিত হওয়াই সবথেকে ভাল। বেলা বাড়লে, আসতে আসতে মাছের সংখ্যাও কমে আসে।
মাছ মেলায় কীভাবে পৌঁছবেন :
হাওড়া থেকে ট্রেনে করে আসুন আদিসপ্তগ্রাম রেলস্টেশন, সেখান থেকে মেলাস্থলের দূরত্ব ১.৫ কিলোমিটার মতো। পায়ে হেঁটে বা স্থানীয় টোটো ভাড়া করে যেতে পারেন। নিজস্ব গাড়ি করে সড়কপথেও হুগলী পেরিয়ে আদিসপ্তগ্রাম পৌঁছতে পারেন খুব সহজেই।
স্থানীয় জনজীবনে মাছমেলার গুরুত্ব :
মাছমেলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, নিকটবর্তী কলেজে আমি পড়তে যেতাম বলে। না হলে সোশ্যাল মিডিয়া, বা শহর কলকাতার লোকমুখে কিন্তু এই মেলার খবর পাওয়া যায় না। মাছমেলা টিও তাই কিন্তু একটা বাণিজ্যিক ব্যাপার নয়, এখানে মাছ ব্যবসায়ীরা আসেন তাদের শ্রেষ্ট ফসল কে তুলে ধরতে, আর পাঁচজন মাছ ব্যবসায়ীর সাথে নিজেদের ব্যবসার হাল হকিকত নিয়ে নানান গল্প করতে। আর মৎস্যপ্রেমীরা এখানে যান, নানান মাছের ভিড় থেকে সেরার সেরা ইলিশ-টা, কাতলা-টা সংগ্রহ করতে।
একটুকরো এই মেলাটিতে তাই মিশে আছে এখানকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, জীবিকা এবং ভবিষ্যৎ। হয়তো এই অজানা মেলাটির মতন গ্রামবাংলার আনাচে কানাচে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে কত শত অজানা মেলার, যেগুলো আমরা কোনওদিন কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য পাইনি। তাই দেরি করবেন না, বেরিয়ে পড়ুন পয়লা মাঘ সকাল সকাল, ছিপ ফেলতে হবে তো!