
সকলের মতো ছেলেবেলায় আমি খুব রূপকথার গল্প পড়তাম। আর এই গল্প পড়ার পর রূপকথার রাজ্যগুলিই স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করত। একদিন স্বপ্নে দেখলাম আমি এমন এক রাজ্যে পৌঁছে গিয়েছি যেখানে প্রাণহীনের জঙ্গল গড়ে উঠেছে । সম্পূর্ণ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে ছোট বড় নানান আকৃতির পাথরের স্তূপ । কি অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, দূর এটা তো স্বপ্ন, এমন আবার হয় নাকি ? তাহলে ভুল ভাবছেন, বাস্তবে সত্যিই এমন জঙ্গলের অস্তিত্ব আছে ।
অবস্থান?
স্টোন ফরেস্ট চিনের বিখ্যাত শহর কুনমিং থেকে ৯০ কিমি দূরে অবস্থিত।
কীভাবে নির্মাণ হল এই স্টোন ফরেস্ট ?

প্রথমেই বলে রাখি, এই স্টোন ফরেস্টটি প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত । ভূতাত্ত্বিকদের মতে প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বছর ধরে নানান ভৌগোলিক কারণ যেমন ক্ষয়, ইত্যাদির কারণেই বিভিন্ন আকারে চুনাপাথরের সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছে স্টোন ফরেস্ট । প্রাগৈতিহাসিক যুগে ইউনান গুইজৌ মালভূমি অঞ্চলে বিশাল মহাসাগরের অবস্থান ছিল। এই অঞ্চলটিতে তীব্র গরম এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের বিকাশ হলেও খুব তাড়াতাড়ি তাদের বিনাশ হয়। দীর্ঘদিন ক্ষয় হয়ে যাওয়া পশুদের ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হাড়গুলি সমুদ্রের তলদেশে পুঞ্জিভূত হতে থাকে ।

মেসোজোইক সময়ে অর্থাৎ ২৫২- ৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে এই পুঞ্জিভূত জীবাশ্ম চুনাপাথরে পরিণত হয়। ভৌগোলিক কারণে একসময় সমুদ্র লুক্কায়িত হলে স্টোন ফরেস্ট এর উদ্ভব হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা প্রায় ১০০০ মিটার ।পরবর্তীকালে আবহাওয়া এবং কার্বনিক- অর্গানিক অ্যাসিডের দ্রবণের কারণে পাথরগুলির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এবং আকারের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে । সম্পূর্ণ স্টোন ফরেস্টটি প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে গঠিত ।
স্টোন ফরেস্টকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত কিংবদন্তি -
কথিত আছে এই অঞ্চলের নিম্নবর্গীয় শানি সম্প্রদায়ের এক অপরূপ সুন্দরী নারী আশিমা এই স্থানেই বাস করত। তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এই অঞ্চলের দুশ্চরিত্র জমিদারের পুত্র আশিমাকে অপহরণ করে বিবাহের প্রস্তাব দেন । এমন সময় আশিমার প্রেমিক আহেই তাকে রক্ষা করে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ।

কিন্তু ঘরে ফেরার পথে বন্যার জলে আশিমা ভেসে যায়, এবং একটি পাথরে পরিণত হয় যা আশিমা রক নামে পরিচিত । এখনও স্টোন ফরেস্টের লেসার স্টোন ফরেস্টে এই পাথরের দর্শন পাওয়া যায় । স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস এই আশিমা রক আজও শানি সম্প্রদায়কে রক্ষা করে চলেছে ।
স্টোন ফরেস্টের দর্শনীয় স্থান -
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া এই স্টোন ফরেস্টের দর্শনীয় স্থান গুলি হল- দ্য গ্রেটার স্টোন ফরেস্ট, দ্য লেসার স্টোন ফরেস্ট, নাইগু স্টোন ফরেস্ট, হিয়ুন গুহা, লং লেক, মুন লেক, কুইফেঙ গুহা, এবং দাদিই জলপ্রপাত ।
গ্রেটার এবং লেসার স্টোন ফরেস্ট -

আপনি যদি সত্যি সত্যিই প্রকৃতি প্রেমিক হয়ে থাকেন তাহলে এই স্টোন ফরেস্টে আপনার জন্য আগাম নিমন্ত্রণ রইলো। এই ফরেস্টটি প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গ্রেটার এবং লেসার স্টোন ফরেস্টটি মূলত চুনাপাথরে নির্মিত । এখানে নানান আকৃতির পাথরের সমাবেশ লক্ষ করা যায় । আর যত বেশি অন্বেষণ করবেন, ততবেশি প্রকৃতির রূপরেখা প্রত্যক্ষ করে আশ্চর্য হবেন।

এখানে বেশ কিছু পাথর রয়েছে যার সাথে পশু, গাছপালা এমনকী মনুষ্য শরীরের গঠনের সঙ্গে হুবহু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় । এই ফরেস্টের অনবদ্য সৃষ্টিগুলি হল - শিলিন লেক, লোটাস পিক, A gleam of sky, আশিমা রক, ইত্যাদি ।
নাইগু স্টোন ফরেস্ট -

এই স্টোন ফরেস্ট তুলনায় কম জনপ্রিয়তা পেয়েছে । তবে সৌন্দর্যের দিক থেকে নাইগু স্টোন ফরেস্টকে কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায় না । চৈনিক ভাষায় প্রকৃতি নাইগু কথার অর্থ হল কালো । আসলে এই স্টোন ফরেস্টের পাথর গুলি ডলোমাইট পাথর দ্বারা গঠিত; আর তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই পাথরের রং কালো বর্ণের । প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নাইগু স্টোন ফরেস্ট। এই ফরেস্টের প্রধান আকর্ষণ গুলি হল - বাইয়ুন লেক, ইস্টার্ন এরিয়া, ওয়েস্টার্ন এরিয়া, ওল্ড ব্যাটেলফিল্ড এবং বাইয়ুন কেভ ।
দ্রষ্টব্যঃ ভ্রমণের সময়ে অন্য ধরণের অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকতে নাইগু স্টোন ফরেস্ট পরিদর্শন করতে কিন্তু ভুলবেন না। ২০০৭ সালে নাইগু স্টোন ফরেস্ট এবং শুওগেয়ি গ্ৰামটি UNESCO-এর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমায় ভূষিত হয়েছে ।
সময়সীমা
চিনের স্টোন ফরেস্ট দর্শনের সময় সীমা হল - সকাল ৮.৩০ থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত ।
পারিপার্শ্বিক দর্শনীয় স্থান
স্টোন ফরেস্ট দর্শন করে আপনি জিউক্সিয়াং, নুহেই গ্রাম, যুয়াঁতং মন্দির এবং ক্সিশান ফরেস্ট পার্ক পরিদর্শন করে নিতে পারেন ।
কীভাবে যাবেন
বিমানে - কলকাতা বা ভারতবর্ষের যে কোনও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পৌঁছে যান চীনের কুনমিং বিমানবন্দর। কুনমিং থেকে সড়কপথে কিংবা রেলপথে পৌঁছে যেতে পারেন স্টোন ফরেস্ট ।
প্রকৃতির লীলাখেলার সাক্ষীবহ এই বিরল নজিরটি প্রত্যক্ষ করার সুযোগটা কি আপনি হাত ছাড়া করতে চাইবেন?