মোকোচুং, ছবিমুড়া এবং আরও অন্যান্য অজানা ডেস্টিনেশন-নর্থ ইস্টের সাতটি রাজ্যের সাতটি অফবিট জায়গা

Tripoto

অ্যা়ডভেঞ্চারের নেশা যাদের রক্তে, চেনাশোনার গণ্ডিতে তাদের বেঁধে রাখা যায় না। নতুনকে জানার, নতুনকে অনুভব করার উৎসাহ সব সময় তাদের ছুটিয়ে নিয়ে চলে একটি অজানা জায়গা থেকে আরেকটি অচেনা জায়গায়। বিদেশ বিভুঁইয়ে ছুটে যাওয়ার দরকার নেই, আমাদের ভারতবর্ষেই আছে এমন অনেক অচেনা ছোট ছোট জায়গা যেখানে না আছে হই হট্টগোল, ভিড় ভাট্টা, না আছে শহুরে কোলাহল আর রোজকার একঘেয়েমি জীবন। আর সেইরকম অফবিট জায়গা খুব সহজেই খুঁজে পাবেন নর্থ ইস্টের সাতটি "সেভেন সিস্টার্স" রাজ্যে। আজ রইল নর্থ ইস্টের সাতটি রাজ্যের সাতটি এরকমই অফবিট জায়গার হদিশ, যেখানে সহজেই হারিয়ে যেতে পারবেন মোবাইলের নেটওয়ার্কের ধরাছোঁয়া থেকে বেশ অনেক দূরে।

নামেরী জাতীয় উদ্যান, অসম

নামেরী জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের পথে (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Nameri National Park And Forest Reserve, Guwahati by Aninda De

অসমের সোনিতপুর জেলায়, পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে রয়েছে নামেরি ন্যাশনাল পার্ক। ভারত সরকার পরিচালিত ২০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই পার্কটিকে ২০০০ সাল নাগাদ টাইগার রিজার্ভ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। ভেতরে দুটি প্রধান ভাগে এই অঞ্চলটি বিভক্ত, নামেরি জাতীয় উদ্যান এবং সোনাই-রুপাই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অভয়ারণ্য। এই অঞ্চলের মধ্যে দেখতে পাবেন একাধিক পাহাড়ি নদী, জিয়া-ভোরোলি ও বোর-দিকোরাই তাদের মধ্যে বিখ্যাত। প্রায় ৬০০টি প্রজাতির উদ্ভিদ আছে এখানে, ফলে হয় বহু পাখীদের সমাগম। তাই পক্ষীবিদ বা বার্ড ওয়াচারদের জন্যে এটি একটি আদর্শ ডেস্টিনেশন। বিপদতালিকায় স্থান প্রাপ্ত হোয়াইট উইংড ডাকের দেখা পাওয়া যায় এখানে।

বন্যপ্রাণীদের দেখতে পাবেন সচক্ষে (ছবি সংগৃহীত)

Photo of মোকোচুং, ছবিমুড়া এবং আরও অন্যান্য অজানা ডেস্টিনেশন-নর্থ ইস্টের সাতটি রাজ্যের সাতটি অফবিট জায়গা by Aninda De

কীভাবে পৌঁছবেন : বিমানপথে তেজপুর এয়ারপোর্টের মাধ্যমে বা ট্রেনে করে রাঙাপাড়া রেলস্টেশনে আসতে পারেন। সেখান থেকে গাড়ি করে বোমডিলা হাইওয়ে হয়ে পৌঁছবেন এখানে।

মোকোচুং, নাগাল্যান্ড

নাগাল্যান্ড রাজ্যের এক শান্ত-স্নিগ্ধ শহরের গল্প (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Mokokchung, Nagaland, India by Aninda De

১৬টি ওয়ার্ড নিয়ে গড়ে উঠেছে উত্তর নাগাল্যান্ডের ছোট্ট পাহাড়ি শহর মোকোচুং। মোকোচুং শহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গোটা মোকোচুং জেলা এবং মিউনিসিপ্যালিটি অঞ্চল। কিন্তু মোকোচুং বিখ্যাত হয়েছে আও মানবগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পীঠস্থান হিসেবে। ব্রিটিশ আমলে নাগা পর্বতে আসাম রাইফেলসের প্রথম আউটপোস্ট হিসেবে গড়ে উঠলেও বর্তমানে এটি হয়ে উঠেছে এই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বাসস্থান। নতুন খাবার, নতুন মানুষ, নতুন ভাবে জীবনকে চিনতে চাইলে চলে আসুন মোকোচুং। মোকোচুং থেকে আশেপাশের চুচুইমপাঙ, খেনসা বা উংমা গ্রাম থেকেও ঘুরে আসতে পারবেন। ছবির মতো সুন্দর লংখুম গ্রাম বা লাংপাংকং গুহা থেকেও ঘুরে আসতে পারেন। প্রতি বছর মে মাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় আও জনগোষ্ঠীর সপ্তাহজুড়ে নবান্ন উৎসব মোয়াৎসু।

কীভাবে পৌঁছবেন : নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর এয়ারপোর্টের থেকে আসামের জোরহাট এয়ারপোর্ট কাছে হবে। ট্রেনে করে আসতে চাইলে পৌঁছে যান মারিয়ানী ট্রেন স্টেশন। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মোকোচুং চলে আসুন। তবে মনে রাখবেন, এখানে আসতে হলে সঙ্গে চাই ইনার লাইন পারমিটের।

তুরা, মেঘালয়

ইকো ট্যুরিজমের স্বাদ পেতে হলে চলুন ঘুরে আসি মেঘালয়ের তুরা শহর থেকে। শিলংয়ের নাম আমাদের সবার জানা হলেও, মেঘালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর তুরা কিন্তু অনেকেরই প্ল্যানের বাইরে থাকে। নেই শিলংয়ের শহুরে যানযট বা গিজগিজে ভিড়, আছে শুধুই মনোরম মেঘালয়ের আসল রূপসী চেহারা।

নির্ভেজাল ঘোরার আনন্দ পেতে চাইলে তুরাকে কেন্দ্র করে ঘুরে আসুন সিজু কেভস, বালপাকরাম ন্যাশনাল পার্ক, নোকরেক ন্যাশনাল পার্ক, পেলগা ফলস বা রংবাংদার জলপ্রপাত থেকে। ঘুরে আসতে পারেন তুরা পর্বত শৃঙ্গ, গারো হিলস বা নাপাখ লেক থেকেও। গ্রীষ্মকালে আর শীতকালে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরূপ হয়ে ওঠে।

কীভাবে পৌঁছবেন : প্লেনে করে চলে আসতে পারেন গুয়াহাটি বা শিলং, ট্রেনে করেও গুয়াহাটি এই অঞ্চলের প্রধান রেলস্টেশন। সেখান থেকে ওভারনাইট বাস বা ভাড়া সুমো বা নিজেদের গাড়ি করে চলে আসুন তুরা।

মেছুখা, অরুণাচল প্রদেশ

অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম শিয়াং জেলার এক কোণে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত মেছুখা বা মেনচুনখা ভ্যালি। স্থানীয় ভাষায় মেন মানে ওষধি, চু মানে জল এবং খা মানে বরফ। কথিত আছে এখানকার বরফ গলা জলে আছে জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার ওষধি দ্রব্যগুণ। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আশীর্বাদ ঘেরা মেছুখায়ে পাইন গাছের ছায়ায় আর ইয়ারগ্যাপছু নদীর পাড়ে বসে আরামসে কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাদিন। দেখা পাবেন মেম্বা, রামো, বোকার এবং লিবো জনগোষ্ঠীর মানুষদের, ঘুরে আসতে পারেন তাওয়াঙ গুম্ফার সমসাময়িক ঐতিহাসিক সামতেন য়ংচা গুম্ফা থেকেও।

কীভাবে পৌঁছবেন : প্লেনে করে গুয়াহাটি পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি করে চলে আসুন পাশিরঘাট। সেখান থেকে বাকি পথ যেতে হবে ভাড়া গাড়িতে। পর্যটকদের দরকার হবে প্রোটেক্টেড এরিয়া পারমিট এবং ইনার লাইন পারমিটের।

উখরুল, মণিপুর

মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের নাম তো বহুল প্রচারিত, কিন্তু মণিপুর থেকে ৮১ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে সবুজে মোড়া হিল স্টেশন উখরুল। এখানকার কাঙখুই গুহা বা হাঙ ডাঙ মাঙ্গা গুহায় কেভ এক্সপ্লোরেশন খুব রোমাঞ্চকর ভাবে ছুটি কাটানোর উপায়। ঘুরে আসতে পারেন দিলি ঝর্ণা থেকে, খাঁটি চা খেতে ইচ্ছে হলে দেখে আসুন নিলাই টি এস্টেট। একটু দূরেই রয়েছে কাচৌফুঙ লেক, যার স্বচ্ছ নীল জলে আকাশের মেঘের প্রতিফলন আপনার মন জয় করে নিতে বাধ্য। ট্রেকিং করতে ইচ্ছে হলে যেতে পারেন খায়াং পাহাড়চূড়া বা শিরুই কাশুং পাহাড়চূড়া, যেখানে আপনি দেখা পেতে পারেন বিরল শিরুই ফুলের। সব মিলিয়ে যেন প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা এক স্বপ্নের দেশ, যা আপনাকে দেবে শান্তি এবং মানসিক পরিপূর্ণতার আশ্বাস।

কীভাবে পৌঁছাবেন : ইম্ফল এয়ারপোর্টে নেমে বাসে বা ট্যাক্সি করে উখরুল আসতে পারেন, অথবা ট্রেনে আসতে চাইলে নামতে হবে ডিমাপুর স্টেশন হয়ে। সড়কপথে আসতে পারেন, সে ক্ষেত্রেও ইম্ফল হয়েই ভিতরে ঢুকতে হবে।

ছবিমুড়া, ত্রিপুরা

ছবিমুড়া বা চক্রাকমা ত্রিপুরার গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত। এই অঞ্চলের খ্যাতির কারণ এখানে গোমতী নদীর তীরে খাড়া ঢাল বেয়ে খোদাই করা আছে নানা হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি এবং ছবি। আছেন শিবঠাকুর, বিষ্ণু, কার্তিকের মূর্তি, আছে ২০ ফুট উঁচু মা দুর্গার মূর্তি। প্রাচীন এই শিল্পকর্ম গুলির সৃষ্টি পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতকে। দেবতামুড়ার প্রায় ৯০ ডিগ্রি খাড়াইতে উঠে যাওয়া পাথুরে দেওয়ালের গায়ে নিখুঁতভাবে আঁকা হয়েছে এই বিগ্রহগুলো। আশেপাশের ঘন জঙ্গলে ইচ্ছে করলে হালকা ট্রেকিংও করতে পারেন। জায়গাটিকে সরকার থেকে একটি ইকো ট্যুরিজম হাব এবং অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস করার জায়গা হিসেবেও জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কীভাবে পৌঁছবেন : ছবিমুড়া পৌঁছনোর জন্যে সড়কপথে উদয়পুর-অমরপুর হাইওয়ে ধরে আসাই সহজ উপায়। অমরপুর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভিতরে এসে ছবিমুড়ার প্রবেশপথ সামনে পাবেন।

লুংলেই, মিজোরাম

মিজোরামের রাজধানী আয়জল থেকে ২৩৫ কিমি দূরে অবস্থিত লুংলেই বিখ্যাত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ব্রিটিশ ইতিহাসের নানা চিহ্নের জন্য। সমগ্র মিজোরামের প্রথম চার্চটি তৈরি হয়েছিল লুংলেই-তেই এবং এখনও পর্যটকরা সেটি দেখতে যেতে পারেন। কাছেই আছে থোরাংটল্যাং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যেখানে সৌভাগ্য হলে দেখতে পাবেন হাতি, সম্বর, হুলক গিবন, জংলি বেড়াল এবং চিতা বাঘ। এখানে দেখতে পাওয়া যায় প্রচুর পরিমানে পাখিদেরও। ঘুরে আসতে পারেন সাজা অভয়ারণ্য থেকেও। মিজো জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি নিয়ে জানতে হলে ঘুরে আসুন সাইকুটি হল থেকে, এখানে আছে লাইব্রেরি, মিউজিয়াম এবং স্থানীয় রেস্টুরেন্ট। দিনের শেষে ঘুরে আসতে পারেন ঘাইশ জলধারার পাশে অবস্থিত সুপ্রাচীন এবং পাথর দিয়ে তৈরি লুংলেই ব্রিজ থেকে।

কীভাবে পৌঁছাবেন : লুংলেই পৌঁছতে হলে বিমানপথে বা সড়কপথে প্রথমে আয়জল পৌঁছাতে পারেন। আয়জল থেকে স্থানীয় বাস বা গাড়ি ভাড়া করে আপনি পৌঁছতে পারেন লুংলেই।

তাহলে আর দেরি নয়, অজানা নর্থ ইস্টের অচেনা এই অফবিট ডেস্টিনেশন গুলির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়া যাক আজকেই!

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।