মুখোশ গ্রামের হাল হকিকত - আফ্রিকান ট্রাইবাল মাস্কের বদলে বাড়ি আনুন বাংলার শিল্পকৃতিকে...

Tripoto

ছৌ নাচের কথা নিশ্চয়ই জানেন। পুরুলিয়া বাঁকুড়ার আদিম জনসংস্কৃতির যে নিদর্শনগুলি এখনও বেঁচে আছে, ছৌ নাচ তার অন্যতম। তবে ছৌ নাচের কথা বললে প্রথমেই মনে পড়ে নৃত্যশিল্পীদের নানা রং-এর বেশভূষা আর ভীষণ ভয়ংকর অথচ ভীষণ সুন্দর বিশাল বিশাল মুখোশগুলোর কথা। যদি বলি, ছৌ নাচ না নেচেও আপনি কিন্তু সংগ্রহ করতে পারেন নিজের জন্যে এই মুখোশ? তাহলে আমাদের সঙ্গে আপনাকেও আসতে হবে পুরুলিয়ার মুখোশ গ্রামে।

রকমারি মুখোশে শিল্পকৃতি (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Charida, Jhalda - Baghmundi Road, চড়িদা, Purulia, West Bengal, India by Aninda De

আসলে মুখোশ গ্রামের আসল নাম মুখোশ গ্রাম নয়। পুরুলিয়া জেলার বাঘমুণ্ডি ব্লকের অন্তর্ভুক্ত চারিদা গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারই কিন্তু জড়িত এই মুখোশ শিল্পের সঙ্গে। গ্রামের মাঝ বরাবর চলে গেছে লম্বা রাস্তা, আর তার দুপাশে যত ঘর আছে সবার সামনে সাজানো নানা রকম মুখোশ। কোনওটা তৈরি, কোনওটার উপর কাজ এখনও হচ্ছে। চারিদা গ্রামের ৩০০- এর অধিক পরিবারের পুরুষ, মহিলা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বৃদ্ধা বা শিশু সন্তান। কোনও না কোনওভাবে সবাই জড়িত এই শিল্পেই। তাই অঞ্চলটির নামই হয়ে উঠেছে মুখোশগ্রাম বা মুখোশপাড়া।

তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন ছোট খাটো বেশ কয়েকটা দোকান। উঁকি দিচ্ছে কোথাও দেবদেবীর মুখ, কোথাও বা কোনও বিভীষণ রাক্ষসের প্রতিচ্ছবি। আর সেই মুখের চারপাশে ঝলমলে কাজ শোলা, রাংতা আর মুকুটের কাজ। বাঘমুণ্ডি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে, চারিদা গ্রামের অবস্থান অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে। গ্রাম বাংলার রুক্ষ জীবনের পটভূমিতে রঙিন এই মুখোশগুলির অস্তিত্ত্ব আলাদা মাত্রা যোগ করে। শুধুমাত্র জীবিকা নির্বাহের পদ্ধতি তা নয়, শিল্পীর ভালোবাসা, অধ্যবসায় এবং সংস্কৃতিকে আঁকড়ে থাকার লড়াই-ও যেন ফুটে ওঠে অব্যক্ত মুখোশগুলির চেহারায়।

শোনা যায়, আগে কেবলমাত্র তথাকথিত নিচু জাতির কারিগররাই শুধুমাত্র এই কাজ করতেন। কিন্তু বর্তমানে জাতপাতের সীমানাতে আর তা আটকে নেই। সকল ইচ্ছুক শিল্পী এই কাজে এগিয়ে আসতে পারেন। তবে বেশিরভাগ পরিবারেই মুখোশ তৈরির কাজ বংশ পরম্পরায় চলে আসছে।

আসুন দেখে নেওয়া যাক এই মুখোশ কীভাবে তৈরি হয়

একটি মুখোশ তৈরি করতে মোটামুটি ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। প্রথমে চারিদা গ্রামের পাশের নদী থেকে মাটি তুলে এনে সেই মাটি দিয়ে মুখোশের অবয়ব তৈরি করা হয়। তারপর তাতে পাতলা কাগজের প্রলেপ পরে। বেশ মোটা করে এই প্রলেপটি দেওয়া হয়। শুকিয়ে গেলে, তার উপরে দেওয়া হয় একস্তর বেলে মাটির প্রলেপ। এই বারে আসতে আসতে নাক চোখ মুখের আদল দেওয়া শুরু হয় এবং তারপর শুকোতে দেওয়া হয় গোটা মুখোশটিকে।

এরপরে দেওয়া হয় খড়ি মাটির প্রলেপ। এই খড়ি মাটি সংগ্রহ করা হয় কলকাতার কুমারটুলি থেকে। খড়িমাটির প্রলেপ শুকালে তার উপর নানান রকম রং করা হয়। তবে এইসময় আবহাওয়া হওয়া দরকার শুষ্ক এবং গরম। মেঘ করলে, বা বৃষ্টি পড়লে সমস্ত পরিশ্রম বৃথা যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। আর সবশেষে সাজানো হয় নানা রকম ফিতে, নকল ফুল, পাতা, রঙিন দড়ি ইত্যাদি দিয়ে।

শুধুমাত্র দেখেই নয় সন্তুষ্ট থাকতে হবে এমন নয়, ইচ্ছে হলে দেখে শুনে নাড়াচাড়া করে কয়েকখানি মুখোশ কিনেও নিয়ে যেতে পারেন। সাইজ, কারিগরি গুণমান এবং মেটিরিয়ালের উপর নির্ভর করে মুখোশ গুলির দাম ১০০০ থেকে ৪০০০ টাকা অবধি হতে পারে। পাবেন হিন্দু দেবদেবীর মুখোশ, অসুর রাক্ষসের মুখোশ, এবং আছে নানা পৌরাণিক চরিত্রের আদলে গড়া মুখোশ।

প্রায় ১৫০ বছর আগে, বাঘমুণ্ডির জমিদার রাজা মদন মোহন সিংহ দেব-এর আমলে ছৌ শিল্পের সূচনা হয়। বর্তমানে বছরে দুবার এখানে পর্যটক সমাগম বেশি পরিমাণে হতে দেখা যায়। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে ছৌ নাচের মুখোশগুলিকে কেন্দ্র করে মেলা আয়োজিত হয়। আর তাছাড়া গ্রীষ্মকালে মার্চ এপ্রিল মাসে ছৌ নাচের পরব যখন বসে, তখনও চারিদা গ্রামের মুখোশগুলি চলে আসে প্রেক্ষাপটে।

কীভাবে পৌঁছবেন

নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে কলকাতা থেকে সময় লাগবে প্রায় ৬ ঘণ্টা। অন্যথায় রেল পথেও যাওয়া যায়। পুরুলিয়া বা বরাভূম স্টেশনে নেমে তারপর যেতে হবে স্থানীয় গাড়িতে। বরাভূম স্টেশন থেকে চারিদা ৩৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।