চলুন এক অন্য রকম রোডট্রিপে, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বিখ্যাত মিষ্টির খোঁজে...

Tripoto

আপনি কি মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন? মিষ্টির খোঁজে বিভিন্ন প্রান্তে পাড়ি দিতে নেই আপনার কোনও আপত্তি? তাহলে চলুন বেরিয়ে পরা যাক, ঘুরে আসি পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে, বিভিন্ন মিষ্টির সন্ধানে। আসলে আমরা যারা শহরকেন্দ্রিক জীবনে ব্যস্ত, ইচ্ছে থাকলেও চেখে দেখতে পারি না আমাদের এই রাজ্যের কিছু স্বল্প পরিচিত, কিন্তু স্বাদের দিক থেকে অভূতপূর্ব কিছু বিশেষ মিষ্টি। আর যদি হাতে থাকে একটু সময়, তাহলে তো গোটা একটা রোড ট্রিপও করে ফেলতে পারেন।

ইতিহাস বলে, মিষ্টি মন্ডা পিঠে পায়েসের দিক থেকে প্রাচীনকাল থেকেই গৌরবঙ্গ বিখ্যাত। জেলাবিশেষে কিছু বিশেষ মিষ্টি আঞ্চলিকভাবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও, বাকি রাজ্যের লোকেদের কাছে পৌঁছতে পারেনি। আবার কিছু মিষ্টি সব জায়গাতে পাওয়া গেলেও, কিছু বিশেষ স্থানে পাওয়া যায় তাদের সেরা রূপে। রয়েছে মিষ্টিগুলোর সৃষ্টির পিছনে হরেক রকম ঐতিহাসিক গল্পও। আসুন, দেওয়া যাক কোন অঞ্চলে কি কি মিষ্টি সেরা!

১. জয়নগরের মোয়া

শুরু করা যাক দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে। চলে আসুন জয়নগরে। প্রতি বছর শীতকালে নতুন নলেন গুড় এবং কনকচূড় খই দিয়ে তৈরি করা হয় এই মিষ্টি, সঙ্গে থাকে গাওয়া ঘি, এলাচ, অল্প পোস্ত। ২০১৫ সালে জয়নগরের মোয়া জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন বা জি.আই ট্যাগ লাভ করে, যার মানে এই মিষ্টির আঞ্চলিকতা জাতীয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত; অর্থাৎ খাঁটি জয়নগরের মোয়া কিন্তু একমাত্র জয়নগরের মিষ্টি কারিগরদের কাছেই পাবেন। শীতকাল এই মোয়া খাওয়ার সবথেকে ভাল সময়।

জয়নগরের মোয়া (সংগৃহীত)

Photo of Joynagar, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : জয়নগর রেলস্টেশনের কাছেই, ১৯২৯ সালে স্থাপিত শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে পাবেন খুব ভালো জনয়নগরের মোয়া।

২. জনাই-এর মনোহরা

হুগলির জনাই গ্রামের খ্যাতি এই মনোহরা মিষ্টির নাম ধরেই। শোনা যায় এই অঞ্চলের জমিদার এক কালে স্থানীয় ময়রাদের কিছু মিষ্টি তৈরি করার আদেশ দিয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে যান। জমিদারের ফিরে আসা পর্যন্ত যাতে মিষ্টি ভাল থাকে, তাই খাঁটি সন্দেশকে চিনির ঘন রসের আস্তরণের ভেতর লুকিয়ে রাখা হয়। অবশেষে সেই মিষ্টি খেয়ে খুব খুশি হয়ে জমিদারবাবু বলেন এই মিষ্টি তার মনকে হরণ করেছে, সেই থেকেই জনাই এর মনোহরার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।

মনোহরা সন্দেশের উপাদেয় সম্ভার (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Janai, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : জনাই বাজারে কমল ময়রার দোকানে বা মা কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে পাবেন ভাল মনোহরা।

৩. বাঁকুড়ার ম্যাচা সন্দেশ

একটি অত্যন্ত স্বল্পপরিচিত কিন্তু স্বাদের দিক থেকে খুব লোভনীয় মিষ্টি হল বাঁকুড়ার বেলিয়াতোরের ম্যাচা সন্দেশ। মল্ল রাজাদের রাজত্বকালে একসময় পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলে দুধের আকাল দেখা যায়। কিন্তু রাজদরবারের ভুরিভোজে মিষ্টি থাকা আবশ্যক। তাই স্থানীয় ময়রারা বেসন দিয়ে, তার সাথে খোয়া এবং চিনি মিশিয়ে, নতুন একরকম মিষ্টি তৈরি করে, যা ম্যাচা সন্দেশ নামে পরিচিত।

বাঁকুড়ার বিখ্যাত ম্যাচা সন্দেশ (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Bankura, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : বেলিয়াতোরের ম্যাচা মহল প্রায় ১৮০ বছর পুরনো একটি বিখ্যাত দোকান, এবং স্থানীয়দের মতে সবচেয়ে ভালো ম্যাচা সন্দেশ এখানেই পাবেন।

৪. নবদ্বীপের ক্ষীরদই

১৯৩০ সালে, নদিয়ার নবদ্বীপে কালিপদ মোদকে তত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত ক্ষীর দই। লাল দই বা চাক্কু দই নামেও এই দই বিখ্যাত। ঘন খাঁটি গরু বা মোষের দুধ অনেক ক্ষণ ধরে ফুটিয়ে ঘন করে প্রায় ক্ষীরের ঘনত্বে নিয়ে যাওয়া হয়। শেষমেশ দই এর উপর পাওয়া যায় ঘন লালচে সুমিষ্ট আস্তরণ।

নবদ্বীপের লাল দই (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Nabadwip, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : চলে যান ১৫০ বছর পুরনো লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এবং এক ভাঁড় দই খেয়ে দেখুন। বড় হাঁড়িতে পাতা দই বাড়ি নিয়েও আস্তে পারেন, প্রায় ১০ দিন মতো এই দই ভাল থাকে।

৫. কৃষ্ণনগরের সরভাজা ও সরপুরিয়া

নদীয়াতেই পাবেন আরও এক অসাধারণ মিষ্টির সন্ধান। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের সরভাজা ও সরপুরিয়া খুবই বিখ্যাত। বর্তমানে দেশের বাইরেও এই মিষ্টি রপ্তানি হয়ে থাকে। আজ থেকে ৫০০ বছরেরও বেশি আগে লেখা চৈতন্য চরিত্রামৃতেও লেখা আছে স্বয়ং চৈতন্যদেব এই সরপুরিয়ার ভক্ত ছিলেন। দুধ গরম করার সময় তার ওপর যে সর পরে, সেই সরের আস্তরণ একের ওপর আরেক ফেলে আসতে আসতে এই মিষ্টিগুলো তৈরি করা হয়। কৃষ্ণনগরের বাইরে বহু জায়গায় সরপুরিয়া বা সরভাজা নামের মিষ্টি পাওয়া যায়, কিন্তু আসল মিষ্টিটা কীরকম তা খেয়ে দেখতে হলে আপনাকে এখানেই আসতে হবে।

কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত সরপুরিয়া (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Krishnanagar, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : নেদিয়াপাড়ার অনন্ত হরি মিত্র রোডের অধর চন্দ্র দাসের মিষ্টির দোকানে এসে খেয়ে দেখুন মিষ্টি গুলো, বংশপরম্পরায় শতবর্ষপ্রাচীন এই দোকানের সুখ্যাতি গোটা রাজ্যজুড়ে।

৬. বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা

গাড়ি ছুটিয়ে চলে আসুন বর্ধমান, কারণ এখানে একটি নয়, দু'দুটি স্পেশাল মিষ্টি অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে। বোঁদে বা বুন্দির একেবারে ক্ষুদ্র সংস্করণ হল মিহিদানা, বেসন, চাল গুঁড়ো, চিনি, আর জাফরান দিয়ে তৈরি করে তারপর ঘিয়ে ভেজে তৈরি করা হয় এই মিষ্টি। আর সীতাভোগ তৈরি করা হয় চাল গুঁড়ো এবং ছানার সংমিশ্রনে। মিহিদানা আর সীতাভোগ একসঙ্গে নিয়ে মিশিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। কলকাতা বা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতে এই মিষ্টিগুলো পাওয়া গেলেও, আসল মজা পাবেন বর্ধমানেই।

সীতাভোগ মিহিদানার জমাটি আলাপ (সংগৃহীত)

Photo of Burdwan, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : কার্জন গেট থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে সরু এক গলির মধ্যে পাবেন গণেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দোকান। সীতাভোগ মিহিদানার জন্যে অন্যতম ভাল দোকান বলা যায়।

৭. মুর্শিদাবাদের ক্ষীরমোহন এবং ছানাবড়া

নবাবি আমেজ পেতে হলে চলে আসুন মুর্শিদাবাদে। এখানকার জিয়াগঞ্জের ক্ষীরমোহন আরেক অসাধারণ সৃষ্টি। ছানা, খোয়া, ক্ষীর, চিনি এবং অল্প এলাচ মিশিয়ে অল্প আঁচে পাক দিয়ে দিয়ে এই মিষ্টি তৈরি করা হয়। তারপর চিনির সিরাপে ফোটানো হয়। মিষ্টিটি দেখতে শেষমেশ অনেকটা চ্যাপ্টা রসগোল্লার মতন, কিন্তু স্বাদে এলাচের একটা সুন্দর প্রাধান্য থাকে।

মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে পাবেন আরেক অতুলনীয় মিষ্টি, নবাবি ঘিয়ে ভাজা ছানাবড়া। পান্তুয়া মতন বাইরেটা আর ভিতরটা অনেকটা রসগোল্লার মতন এই মিষ্টির। এটাতেও পাবেন এলাচের সুন্দর গন্ধ ও স্বাদ।

মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ছানাবড়া (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Murshidabad, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : বহরমপুরের গোরাবাজারের আনন্দ সুইটসে চেখে দেখতে পারেন এই মিষ্টি গুলি। আর গরমকালে মুর্শিদাবাদ গেলে আম খেতে ভুলবেন না।

৮. মেদিনীপুরের বাবারসা

এবার চলুন যাওয়া যাক মেদিনীপুরে, প্রায় ২৫০ বছর প্রাচীন এক মিষ্টির খোঁজে। মুর্শিদাবাদের খিরপাই অঞ্চলে ১৭৫০ সাল নাগাদ এই মিষ্টি তৈরি হয়। প্রধান উপকরণ বলতে গরম ঘি, ময়দা আর খাঁটি মধু। লক্ষণীয় যে এটি এরম এক মিষ্টি যাতে দুধ বা ছানার ব্যবহার নেই। মিষ্টিটির নামকরণের পিছনেও আছে বিভিন্ন গল্প, মুঘল সম্রাট বাবর বা তৎকালীন এক ইংরেজ অফিসার এডওয়ার্ড বাবর্শ'র নাম অনুযায়ী এই মিষ্টির নাম রাখা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

মেদিনীপুরের বিখ্যাত বাবারসার ছবি (সংগৃহীত)

Photo of Medinipur, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : খিরপাই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানীয় মিষ্টির দোকানে এই মিষ্টি পাওয়া যায়, তবে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যশালী মিষ্টিটি। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুরে আসুন খিরপাই থেকে।

৯. শক্তিগড়ের ল্যাংচা

গাড়ি চালাতে চালাতে যদি দেখেন রাস্তার দুপাশে পর পর ল্যাংচা মহল, ল্যাংচা প্যালেস, ল্যাংচা ভাণ্ডার জাতীয় দোকানের সারি, বুঝবেন আপনি শক্তিগড় পৌঁছে গেছেন। ময়দা, ছানা, খোয়া ক্ষীর দিয়ে তৈরি রসে ডোবানো শক্তিগড়ের ল্যাংচা আজ পৃথিবীবিখ্যাত, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতেও এই মিষ্টির ডেলিভারি যায়।

মিষ্টিপ্রেমী মানুষদের পছন্দের মিষ্টি (সংগৃহীত)

Photo of Saktigarh, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : ন্যাশনাল হাইওয়ের দুইপারে সারি সারি বিভিন্ন দোকান পাবেন ল্যাংচা'র। সব কটি দোকানই বেশ ভাল, আপনার পছন্দ মতো যে কোনও দোকান থেকে খেয়ে দেখতে পারেন।

১০. কলকাতার রসগোল্লা

শেষ পাতে চলে আসুন শহর কলকাতায়। স্বল্প পরিচিত না হলেও উত্তর কলকাতার রসগোল্লার নরম তুলতুলে উষ্ণ স্বাদ আজীবন মনে রাখার মতন। জি.আই ট্যাগ প্রাপ্ত কলকাতা রসগোল্লার স্বাদ কিন্তু বাকি রাজ্যে বা দেশে আর কোথাও পাবেন না।

মিষ্টিপ্রেমী মানুষদের অন্যতম পছন্দের মিষ্টি রসগোল্লা (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Kolkata, West Bengal, India by Aninda De

কোথায় খাবেন : বাগবাজারের নবীন চন্দ্র দাসের মিষ্টির দোকান রসগোল্লার আবিষ্কারক হিসেবে পৃথিবীবিখ্যাত। এদের স্পঞ্জ সাদা রসগোল্লা সত্যি অতুলনীয়।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যাবহার করুন।