পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম...

Tripoto
Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 1/10 by Deya Das
পটচিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে পৌরাণিক গাথা (ছবি সংগৃহীত)

কলকাতা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা ব্লকের একটি ছোট্ট গ্রাম নয়া। এই গ্রামের সঙ্গে মিশে আছে পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম শিল্পমাধ্যমের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ইতিহাস, যা শুধু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে নয় বিশ্বের দরবারে আজ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পিংলা ব্লকের নয়া গ্রাম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে একমাত্র পটচিত্র গ্রাম, যেখানে প্রবেশ করার পরেই আপনি এক অদ্ভুত পরিবেশের আত্মোপলব্ধি করতে পারবেন। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে এবং উঠোনে এই পটচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, বাড়ির সামনেই এরা পটচিত্রের পসরা সাজিয়ে বসে, আবার কেউ কেউ ঘরের সামনে বসেই ছবি আঁকেন। পূর্বে এই পটচিত্রের প্রভাব তেমন দেখা না গেলেও ১০ বছর দশেক আগে কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাংলা নাটক ডট কম ও পটশিল্পীদের সংস্থা চিত্রতরুর উদ্যোগে এই গ্রামের পটের মেলার আয়োজন করা হয় এবং তারপর থেকেই শিল্প দেশ-বিদেশে তার স্থান করে নেয়।

পটচিত্র শিল্পীদের কাহিনি-

Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 2/10 by Deya Das
তুলির টানে প্রকাশ পেয়েছে শিল্পীর শৈল্পিক প্রতিভা (ছবি সংগৃহীত)

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী বিশ্বকর্মার ঔরসে স্বর্গের সংগীতশিল্পী অপ্সরার গর্ভে মালাকার, কর্মকার, শঙ্খকার, তন্তুবাই, কুম্ভকার, কাঁসার, সূত্রধর, চিত্রকর এবং স্বর্ণকার নামের নয়জন শিল্পীর জন্ম হয়। এদের মধ্যে অষ্টম গর্ভজাত সন্তান হলেন চিত্রকর।

Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 3/10 by Deya Das
ছবি সংগৃহীত

নয়া গ্রামে প্রায় ৭০টিরও বেশি পরিবারের প্রায় ২৫০ জন পটুয়া এই পটচিত্র এঁকে থাকেন। এদেরকে চিত্রকর বলা হয়। কারোও কারোও মতে, এই সমস্ত চিত্রকরেরা বিশ্বকর্মার বংশধর হিসেবে পরিচিত। পুরাণে মনে করা হয়, ফকির পটুয়া নামের এক চিত্রকর সম্প্রদায় কোন এক নরখাদক দৈত্যের ছবি এঁকে সেই দৈত্যকে বোকা বানিয়ে হত্যা করেছিলেন। আর তারপর থেকেই ফকির পটুয়ার নামে এই সম্প্রদায়ের নামকরণ হয়। প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর আগে এই সমস্ত পটশিল্পীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে পটগান গাইতেন। তাদের গান শুনে কেউ টাকা দিতেন, কেউ বা চাল-ডাল দিতেন। এইভাবেই তাদের কোনও রকমে সংসার চলত। কোনও এক সময় এই সমস্ত পটচিত্রকরেরা তাদের শিল্পকলাকে বিক্রি করতে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পরত বিভিন্ন গ্রামে। সেখানে স্থানীয় বাড়িতে ঢুকে বেহুলা লক্ষীন্দর, চণ্ডীমঙ্গল বা সাবিত্রী সত্যবানের মতো বিভিন্ন পুরাণকাহিনি নিয়ে নিজেদের আঁকা ছবি দেখাতেন। বর্তমানে ঠিক আছে শুধু বাড়ির বড়রা নয় খুদে শিল্পীরাও তাদের চমৎকারিত্ব প্রদান করছে।

পটচিত্রের উত্থান-

Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 4/10 by Deya Das
পটচিত্রের মাধ্যমে চিত্রকরদের সাবলীল প্রকাশনা (ছবি সংগৃহীত)

সংস্কৃত ‘পট’ শব্দের অর্থ হল কাপড়, আর ‘চিত্র’ মানে ছবি অর্থাৎ পটচিত্র বলতে কাপড়ের উপর অঙ্কিত চিত্রকে বোঝানো হয়। এই চিত্র অঙ্কন করার জন্য প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি সমস্ত রং ব্যবহার করা হয়,যেমন- গাছের সিম দিয়ে সবুজ রং, ভুসোকালি দিয়ে কালো রং, অপরাজিতা ফুল দিয়ে নীল রং, সেগুন গাছের পাতা দিয়ে মেরুন রং, পান-সুপারি চুন দিয়ে লাল রং, পুঁই ফল দিয়ে গোলাপি রং, কাঁচা হলুদ দিয়ে হলুদ রং, পুকুর খনন করে মাটি বের করে তা দিয়ে সাদা রং ইত্যাদি। সাধারণত এই সমস্ত প্রাকৃতিক রং দিয়ে, ছাতা, হাতপাখা, হ্যান্ডব্যাগ, মোড়া, লন্ঠন, কেটলি ইত্যাদি আঁকা হলেও; শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, টি-শার্ট-এ তারা ফেব্রিক রং করে থাকেন।

Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 5/10 by Deya Das
Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 6/10 by Deya Das
ছবি সংগৃহীত

ধর্মীয় মেলবন্ধন-

এই গ্রামের বেশিরভাগ পটুয়ারাই কিন্তু মুসলিম ধর্মাবলম্বী। তা হলেও তারা রামায়ণ, মহাভারত, দুর্গা কাহিনী মঙ্গলকাব্যের বিভিন্ন পটচিত্র এঁকে থাকেন। সেই জন্যই হয়ত ধর্মীয় সম্প্রীতির মেলবন্ধনের ছবি এই গ্রামেই ধরা পরে।

Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 7/10 by Deya Das
ধর্মীয় মেলবন্ধনের এক প্রতিফলন (ছবি সংগৃহীত)

‘আকবরনামা’ সহ বিভিন্ন মোঘল গ্রন্থে, জৈনদের ২৪তম মহাবীরের ধর্মগ্রন্থ ‘কল্পসূত্র’-এ, কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’, বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ এবং বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’- এ এই সমস্ত চিত্রকরদের কথার উল্লেখ রয়েছে।

Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 8/10 by Deya Das
চিত্রকরদের নমুনা (ছবি সংগৃহীত)

এই নয়া গ্রামের স্বর্ণ চিত্রকর নামে একজন পটুয়া রমণী তাঁর আঁকা রামায়ণ মহাভারত ও সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে তৈরী পটচিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন। সেই কারণে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে পৌঁছে তিনি ছবি আঁকা সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়াও আমেরিকা, প্যারিস, জার্মানি, ইতালি, সুইডেন বিভিন্ন জায়গায় তিনি একাধিকবার ভ্রমণ করেছেন কর্মসূত্রে।

Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 9/10 by Deya Das
বৈদেশিক স্বীকৃতি (ছবি সংগৃহীত)

কীভাবে পৌঁছবেন-

Photo of পটচিত্রে ধর্মীয় সম্মেলনের চিন্তায় পিংলার নয়াগ্রাম... 10/10 by Deya Das

হাওড়া থেকে খড়গপুর অথবা মেদিনীপুর কিংবা বালিচকগামী ট্রেনে চড়ে বালিচক স্টেশনে নেমে, সেখান থেকে বাস, ট্রেকার অথবা ভাড়ার গাড়ি করে ২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলেই এই গ্রামের সন্ধান পাবেন।

আবার অন্যদিকে কলকাতা থেকে নিজস্ব গাড়িতে ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে ডেবরা থেকে বালিচক স্টেশনের রেলগেট পেরোলে মুন্ডুমারী মোড় পরবে, সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে রাস্তা ধরলে এই গ্রামে পৌঁছানো যায়। কলকাতা থেকে নয়াগ্রাম এর দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।