সম্প্রতি কিছু বছর ধরে সারা বিশ্ব কোরিয়ান সংস্কৃতির ধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে চলেছে। কে-পপ থেকে কোরিয়ান বিউটি ব্র্যান্ডস, সব কিছুতে আজ কোরিয়ার ছোঁয়া লেগে গিয়েছে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকলেও দক্ষিণ কোরিয়া কিন্তু ভ্রমণকারীদের কাছে কিছুটা হলেও অফবিট গন্তব্য স্থান। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার কথা মাথায় এলে সর্বপ্রথম যে দুটি শব্দ মনে পরে তা হল কিমছি এবং কোরিয়ান বারবিকিউ। ৫১ মিলিয়ন মানুষ বসবাসকারী এই দেশে কার্যক্রমের এত আধিক্য হয়তো আপনি বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাবেন না। এরমধ্যে কিছু মজাদার অভিজ্ঞতার কথা আমি আপনাদেরকে আজ বলব।
যদি আপনি সকালের স্নিগ্ধতাকে উপভোগ করতে কোন জায়গা পরিভ্রমণের পরিকল্পনা করেন, তাহলে আপনাদেরকে আমরা আমাদের কিছু অভিজ্ঞতার কথা শোনাবো এবং জানাবো সেই সব জায়গার কথা।
কোরিয়ান বাথ হাউসে স্পা-এর আনন্দ উপভোগ:
কোরিয়ান সংস্কৃতিতে বাথ হাউস একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে স্পা নেওয়ার জন্য এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা সারাদিন অপেক্ষা করে। কোরিয়ান বাথ হাউস বা জ্জিমজজিলবাং-এর পরিষেবাতে কিন্তু লিঙ্গ পৃথকীকরণ করে দেওয়া হয়। তবে কিছু জায়গা আছে যেখানে সবাই প্রবেশ করতে পারবেন। এই স্থানে অ্যারোমা পুল, কফি-বাথ, রেড-ওয়াইন বাথ-এর সুযোগ দেওয়া হয়। অ্যারোমা পুলে স্নান করার পর প্রত্যেক আগত অতিথিরা এখানের একটি ঘরে ‘সৌনা’ বা আরাম করতে পারেন। কোরিয়ায় সমস্ত স্পা সেন্টারগুলো মোটামুটি ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে আর এখানে এসে অতিথিরা যাতে রাত কাটাতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা আছে।
কোরিয়ান খাবারের স্বাদ আস্বাদনের জন্য সিওলে একদিন:
কোরিয়া এখন পর্যন্ত প্রসিদ্ধ তার নিজস্ব বিভিন্নরকম খাবার প্রস্তুতির জন্য। যদি আপনি কোরিয়ায় প্রথমবার ভ্রমণ করতে আসেন তাহলে এখানকার খাবার আপনাকে অত্যন্ত তৃপ্তি দেবে। দ্বিধা কাটিয়ে বিভিন্ন কোরিয়ান খাবারের স্বাদ যদি পেতে চান তাহলে অবশ্যই ফুড ট্যুরে আপনি যোগদান করতে পারেন। লোকাল ট্যুর গাইডের সাহায্যে এবং সিওলের (কোরিয়ার রাজধানী) রেস্টুরেন্টগুলোর থেকে আপনি ঘরে তৈরি বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার খেতে পারবেন। এখানে আপনি সুপরিচিত খাবার যেমন কোরিয়ান বারবিকিউ এবং কিমছি খেয়ে দেখতে পারেন। এছাড়াও কিছু অজানা খাবার যেমন বিংসু আইসক্রিম এবং কিমবাপ রোলস এর স্বাদ নিতে পারেন।
বহু থিমের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ক্যাফেতে একদিন সময় কাটানো:
বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমরা থিম ক্যাফে দেখতে পাই। কিন্তু তাদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় এবং উন্নত মানের ক্যাফেটি দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত। সিওল-এ অবস্থিত এই ক্যাফেগুলোতে আপনি অনায়াসে একটি দিন কাটিয়ে ফেলতে পারবেন।
কিছু অসামান্য হাতে তৈরি জলখাবার:
বিশ্বের যে কোনও জায়গায় যে কোনও খাবার যদি আপনি খেয়ে থাকেন,তবে দেখবেন শুধু কোরিয়ান মূলধারার খাবার নয়, তাদের তৈরি হাতে গড়া জলখাবারগুলোও অন্য স্বাদ বহন করে। এর মধ্যে জনপ্রিয় খাবার হল বেণ্ডেজি বা রেশমের শুকনো কৃমি। এই কোরিয়ান বার স্নাক্সটি পরিবেশন করা হয় রাইস হুইস্কি এবং সজু-র সঙ্গে। এখানকার এই স্থানীয় খাবারগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন দোকান পাওয়া যায়। তার সাথে ব্যাপকভাবে প্রতিটি বারেও পরিবেশন করা হয়। যদি আপনি সতেজ স্টিউড চান, তাহলে রাস্তার পাশে বসে থাকা দোকানের কাছ থেকে তা বানিয়ে নিতে পারেন। কারণ তারা আপনার সামনের সেটি তৈরি করে পরিবেশন করবে।
বেণ্ডেজি-র সঙ্গে আপনি কাঁকড়ার চিপস, চিংড়ির স্নাক্স, রাইস ক্র্যাকার এবং অন্য কিছুও খেতে পারেন।
কোরিয়ান সুরা পান করার জায়গা:
রাইস ওয়াইন ম্যাকজল্লি এখানকার অন্যতম বিখ্যাত পানীয় মাদকদ্রব্য হিসেবে স্বীকৃত, যা শুধু কোরিয়াতে নয় আস্তে আস্তে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কোরিয়ার পর্যটন অংশ হিসেবে আপনি এই ম্যাকজল্লি বানানো শিখে নিতে পারেন। পানীয় মাদক প্রস্তুতকারক কোম্পানি বাইসাঙময়এং যুগ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে তার প্রস্তুত করা কোরিয়ান পানীয়ের জন্য এবং তার সঙ্গে তারা রাজধানী সিওলবাসীদের এই পানীয় তৈরি উপযুক্ত পন্থা শিখিয়ে দেয়। মাত্র $২০( ২৫,০০০ কেআরডাব্লু) বিনিময়ে তারা প্রতি সপ্তাহে পানীয় প্রস্তুতি শেখানোর ক্লাস দিয়ে থাকে।। তাই আপনি চাইলে অনায়াসে এখান থেকে ম্যাকজল্লি বানানো শিখে নিতে পারেন এবং প্রয়োজনে আপনার জন্য দু বোতল ম্যাকজল্লি বানিয়ে নিয়েও যেতে পারেন। এটি আপনার জন্য নিঃসন্দেহে একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়ে উঠবে।
ভোরবেলা বা সন্ধ্যার সময় কেনাকাটা:
দক্ষিণ কোরিয়ায় রাত্রিকালীন বাজারে আপনি চাইলেই কেনাকাটা করতে পারেন। এখানকার ডংদাইমুন বাজারটি ২ ৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এবং ফ্যাশনপ্রেমীদের জন্য এটি একটি অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা। এখান থেকে আপনি খুব স্বল্প দামে ব্যাগ, অলংকার, জামাকাপড়, জুতো সমস্ত কিছু কিনতে পারবেন। তবে একটা জিনিস মনে রাখবেন, যত রাত করে আপনি এই বাজারের কেনাকাটা করতে যাবেন তত এখানে ভিড় বাড়বে। এই বাজারে রয়েছে প্রচুর খাবারের দোকানে, সঙ্গে রয়েছে প্রতিদিনের কিছু অনুষ্ঠানের সরাসরি পরিবেশনা, যা আপনার কেনাকাটার সঙ্গে প্রতিনিয়ত আনন্দ দিয়ে চলবে।
ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান গৃহে রাত্রিযাপন:
‘হানক’ দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী গৃহ। যেখানে না থাকলে হয়তো আপনার দক্ষিণ কোরিয়া ভ্রমণ করার আনন্দ অধরা থেকে যাবে। দক্ষিণ কোরিয়াকে ঐতিহাসিক দিক থেকে বিশ্লেষণের জন্য হানক অন্যতম একটি জায়গা। প্রতিটি হানক গড়ে উঠেছে মাটির দেওয়াল, কাঠের পিলার এবং ডাইচেংমারু (কাঠের তৈরি হয়েছে) সংযোগে। ‘আনডং’ এবং ‘জেনজু’-এই দুটি জায়গায় আপনি খুঁজে পাবেন একদম ঐতিহ্যবাহী হানক। ক্লান্তি জীবন থেকে একটু অবসরের আশায় যদি আপনি এই কোরিয়ায় ঘুরতে আসেন, তাহলে সাধারণ হোটেলের জাঁকজমকপূর্ণতা থেকে ছুটি নিয়ে কিছুদিন এই ঐতিহ্যবাহী হানকগুলোতে থেকে দেখতেই পারেন।
কোরিয়ান সংস্কৃতি অন্বেষণে- গাঙনাম:
৯০ দশক থেকে সারাবিশ্বে কোরিয়ান সংস্কৃতি ছড়িয়ে পরতে শুরু করে। গাঙনাম সংস্কৃতি (যা পি-এস-ওয়াই গাঙনাম রীতির জন্য বিখ্যাত) যে এই ধারার মূল সূচক, সেটা বললে কিন্তু মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না।
অনেক নবপ্রজন্মের তারকার জন্মস্থান এই কোরিয়া এবং তাঁরা নানান সময়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। বহুল পরিমাণে বিনোদনবিষয়ক কোরিয়ান কোম্পানিগুলো এখানকার স্থানীয়। এই কারণেই বিখ্যাত জায়গা কে-স্টার রোড থেকে কে-পপ'স এই দুটি অঞ্চল হয়ে যায়। তাই কে পপ গ্রুপের লোগো এবং বিয়ার (গাঙনাম পুতুল) হাতে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে লোকজন সমগ্র রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই স্থানে ঘুরতে এলে আপনি দেখতে পাবেন কোরিয়ান পপ সংস্কৃতির আসল প্রভাব। আর এই পথে খুঁজে পাবেন একটি রেস্তোরাঁ।
একদিনের জন্য ইরোটিক উদ্যানে ভ্রমণ:
যদিও কোরিয়াতে দেহতত্ত্ব সম্বন্ধীয় বিষয় সবসময় বিতর্ক সৃষ্টি করে; তবুও এখানে বেশ কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে এই ভালোবাসায় ভরা দেহতত্ত্ব বিষয়ক মূর্তি এবং চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে এই জায়গাটি ভ্রমণকারীদের জন্য খুবই আকর্ষণীয় একটি স্থান। বিখ্যাত উদ্যানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ‘সামচেওক হাইসিংদাং পার্ক’, যা ‘পেনিস পার্ক’ নামে পরিচিত। এই উদ্যানে রয়েছে বিখ্যাত কিছু ফলিক মূর্তি। কথিত আছে, এই পেনিস আকৃতির মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছে কোন এক কুমারী মেয়ের বিয়ের প্রতি আগ্রহ জাগানোর জন্য।
অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়া কিন্তু আবার ভালোবাসার ভূমি হিসেবে পরিচিত। দক্ষিনাস্থ দ্বীপ জেজু-তে রয়েছে অপ্রচলিত দেহতত্ত্ব নির্ভর থিম পার্ক, যেখানে শত শত ভাস্কর্য, বিভিন্ন প্রদর্শনী এবং বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির চিত্রকলা দেখতে পাওয়া যায়। ২০ বছরের নীচে এই উদ্যানে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
ডিএমজেড ট্যুর:
উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ডিএমজেড বা ডেমিলিটারিসিড জোন সক্রিয় সামরিক এবং বাফার জোন হিসেবে পরিচিত। ইতিহাস প্রেমী এবং আগ্রহী পর্যটকেরা খুব সহজেই সিওল থেকে ডিএমজেড ঘোরার জন্য জায়গা নির্বাচন করতে পারবেন এবং সেই জায়গায় সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে বর্ডার জীবন সম্বন্ধে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। ভ্রমণ চলাকালীন আপনি প্রাকৃতিক সংরক্ষণে গড়ে ওঠা পরিবেশ এবং ডেল্টা নদী দেখতে পাবেন। তবে মনে রাখতে হবে, এই স্থানে আসতে গেলে ৪৮ ঘণ্টা আগে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর কাজকর্মের দিনগুলোতে এবং কোন ছুটিতে এই স্থানে আসা যাবে না।