সুযোগ থাকলে হয়তো বাঙালিরা সারা বছর ঘুরে বেড়িয়েই কাটিয়ে দিত। কিন্তু নানা কারণে, দায়িত্বের চাপে, সময়ের অভাবে সবসময় সবার পক্ষে ঘুরতে যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে মানসভ্রমণের জন্যে কিন্তু বাংলা সাহিত্যের মতন সুসমৃদ্ধ ভাণ্ডার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বহু জ্ঞানী-গুণী লেখকের অবদানে বাংলা ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে এমন কিছু আন্তরিক ভ্রমণ কাহিনি, যা পাঠকদের নিয়ে চলে নতুন দুনিয়ায়। আমাদের পাঠকদের জন্যে রইল সেরকমই কিছু সেরা বইয়ের খোঁজ।
দেশে বিদেশে - সৈয়দ মুজতবা আলী
লেখক, সাংবাদিক, পর্যটক, ভাষাবিদ - বাঙালি হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর গভীর প্রজ্ঞা আমাদের সঙ্গে বাংলা ভাষায় ভাগ করে নিয়েছেন। বহু দেশে বহু বছর ধরে তিনি ভ্রমণ করেছেন এবং লিপিবদ্ধ । দেশে বিদেশে তাঁর লেখা প্রথম বই। বইতে বর্ণিত আছে ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সালে তাঁর কাবুলে থাকার অভিজ্ঞতা। সহজ সাবলীল ভাষায় কাবুলদেশের জীবনযাত্রা এবং সামাজিক জীবনব্যবস্থার কথা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, হাস্যরসের মোড়কে। তাঁর লেখার এই কৌতূকবোধ পাঠকদের বড় পাওনা।
ভ্রমণসমগ্র - হুমায়ূন আহমেদ
বাংলাদেশের বন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমেদের লেখক হিসেবে পরিচিতি প্রধানত তাঁর হিমু এবং মিসির আলী চরিত্রগুলি নিয়ে লেখা গল্পগুলি নিয়ে। তবে তা ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন পায়ের তলায় খড়ম, রাবণের দেশে আমি এবং আমরা, দেখা না দেখা, হোটেল গ্রেভার ইন, মে ফ্লাওয়ার এবং যশোহা বৃক্ষের দেশে নামক ৬টি ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ। সদলবলে বিদেশ বিভুঁইতে থাকা, ঘোরা, জীবন কাটানোর মুখরোচক গল্প দুই মলাতে তাঁর ভ্রমণসমগ্রের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর লেখার বিশেষ গুণ জটিল কথা মজার ছলে সহজ ভাষায় আমাদের উপহার দেওয়া।
ভ্রমণসমগ্র - নবনীতা দেবসেন
বর্তমান কালের বাংলা সাহিত্যে নবনীতা দেবসেন এক প্রথিতযশা লেখিকা। সদ্যপ্রয়াত হয়েও তাঁর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে দেয় কত সহজে কত মানুষের মনে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি দান করেছেন প্রায় ৮০টি অমূল্য বই। সহজ সাবলীল ভাষায় রম্যরসের সঙ্গে রোমান্টিক ভাবধারার মিলন ঘটেছিল তাঁর লেখায়। ভারতবর্ষ, এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা একসঙ্গে দু মলাটের ভিতরে পাওয়া যাবে তাঁর ভ্রমনসমগ্র বইগুলির বিভিন্ন খণ্ডে।
বাঙালের আমেরিকা দর্শন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শীর্ষেন্দু বাবুর লেখনীর ভক্ত মাত্রেই জানেন যে কি সহজে তিনি আপামর মধ্যবিত্ত বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, ভালোবাসা, আবেগের কথা মাত্র কয়েকটি বাক্যেই তুলে ধরতে পারেন। আমেরিকা দর্শন বইটিতেও যেন সেই মধ্যবিত্তের চোখে আমেরিকার রূপ ধরা পড়েছে। বাংলার মাটি ছেড়ে সীমিত ক্ষমতায়, সীমিত জ্ঞান সঙ্গে নিয়ে প্রথম বিশ্বের দেশ দেখার এক অনন্য অভিজ্ঞতা এই বইতে লিপিবদ্ধ। রয়েছে বিদেশে বসবাসকারী বাঙালীদের জীবনযাত্রার বর্ণনাও।
জাপান থেকে ফিরে - নারায়ণ সান্যাল
টানটান উত্তেজনায় ভরপুর লেখা; ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন থেকে শুরু করে গল্প উপন্যাসে অবাধ বিচরণ নারায়ণ বাবুর। তাঁর জাপান থেকে ফিরে বইটিতে রয়েছে জাপানে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড এক্সপো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার গল্প এবং জাপান দেশে তাঁর নানান অভিজ্ঞতার কথা। আছে জাপানের সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার নানান বিবরণ। জাপানী থিয়েটার, তাঁদের ঠাকুর দেবতা, পুষ্পশিল্প, সব মিলিয়ে পাঠক যেন পৌঁছে যায় লেখকের চোখ দিয়ে জাপানে। উপরি পাওনা, লেখকের নিজের হাতে আঁকা বেশ কিছু ছবি।
পায়ের তলায় সর্ষে - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সুনীল গাঙ্গুলির লেখনীতে বিশ্বভ্রমণের গল্প পড়তে পাওয়া পাঠক হিসাবে আমাদের সৌভাগ্যের বিষয়। তাঁর যাবতীয় ভ্রমণকথা স্থান পেয়েছে দু-খণ্ডে সংকলিত পায়ের তলায় বিশ্ব বইটিতে। আছে এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানো মানুষ জনের সঙ্গে মেলামেশার বিশদ সরস বিবরণ। বহু বছর ধরে ঘটমান এই ভ্রাম্যমাণ জীবনকে কাছ থেকে দেখার এরম সুযোগ একেবারেই পাঠকের হাতছাড়া করা উচিত নয়।
দু চাকায় দুনিয়া - বিমল মুখার্জি
সময় টা ১৯২৬, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অপেক্ষাকৃত শান্তির আবহ। তার মাঝে এক বঙ্গসন্তান বেরিয়েছেন বিশ্বভ্রমণে - আরব, ইরান, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, চিন, হং-কং, ভিয়েতনাম মিলিয়ে সমস্ত বড় দেশ গুলি ঘুরে দেশে ফেরেন ১৯৩৭ সালে - শুধুমাত্র তাঁর দু-চাকার সাইকেলের উপর ভরসা করে। নামমাত্র অর্থ নিয়েও কেবলমাত্র দুনিয়াকে দেখার নেশায় এই দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়েছিলেন কোনো ভয়ডরের তোয়াক্কা না করেই। এই বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর বিপুল এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ইতিহাসের জীবন্ত দলিল এই কালজয়ী বইটি, দুনিয়ার দরবারে দুরন্ত বাঙালির বিশ্বজয়ের প্রতীক।
হলদে পরীর দেশে - জসীমউদ্দিন
কবি জসীমউদ্দিনের লেখনীতে মায়া মমতা সারল্যের ছাপ আমাদের সবসময়ই মুগ্ধ করেছে। লেখক, গীতিকার, কবি হিসেবে বারবার তিনি উপহার দিয়েছেন কালজয়ী সাহিত্য। হলদে পরীর দেশে তাঁর হাতে গোনা কিছু ভ্রমণ বিষয়ক বইগুলির মধ্যে অন্যতম। রচিত আছে লেখকের যুগোস্লাভিয়া ভ্রমণের কাহিনি, আছে কিছুদিন রোম দেশে কাটানোর বিবরণ ও। এই বইটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল পাতায় পাতায় আন্তরিকতার ছোঁয়া। দেশ কাল সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে মানুষ হিসাবে ওপর মানুষকে আপন করে নেওয়ার দিশা খুঁজে পাওয়া যাবে হলদে পরীর দেশে।