দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামের পৌরাণিক ইতিকথা এবং শিবরাত্রি যাপন...

Tripoto

ভক্ত সমাবেশের ছবি (সংগৃহীত)

Photo of Deogarh, Odisha, India by Deya Das

সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দুধর্মের প্রধান দেবতা হিসেবে যাকে উপাসনা করা হয় তিনি হলেন ভগবান শিব । আবার তিনি সৃষ্টির আধার হিসেবেও পরিচিত । মানুষের বিশ্বাস ভগবান শিব হলেন স্বয়ম্ভু, অর্থাৎ শিব মনুষ্য বেশধারণ করে জন্মগ্রহণ করেননি, তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গঠিত। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী তিনি হলেন আদি-দেব, যার অর্থ হল প্রাচীনতম দেবতা। বিখ্যাত সংস্কৃত অধ্যাপক স্যার মনিয়ের উইলিয়াম এর মতে, সংস্কৃত শব্দ 'শিবা ' এর অর্থ হল 'মঙ্গলজনক, প্রসন্ন, কল্যাণময়,সৌম্য, দয়ালু, হিতৈষী'। ঋকবেদ অনুসারে, ঋকবৈদিক যুগের দেবতাদের সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রদেবের প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে শিব শব্দের অর্থ হল-যিনি কল্যাণময় ।

ভারতে শিবরাত্রির মাহাত্ম্য

আক্ষরিক অর্থে মহাশিবরাত্রি শব্দটি বিশ্লেষণ করলে জানা যায় ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে একটা রাত্রি যাপন। আর আমাদের দেশের সর্বত্রই ধুমধাম করে এই উৎসব পালন করা হয়। কথিত আছে, শিবরাত্রির মহালগ্নেই শিবের তাণ্ডব নৃত্য (দৈবিক নৃত্য) সম্পন্ন হয়েছিল। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ফাল্গুন মাসের বিশেষ তিথিতে এই শিবরাত্রি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ভক্তরা তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য উপবাস করে পূজার্চনা করে থাকেন।

দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধাম

জাঁকজমকপূর্ণ বৈদ্যনাথ ধাম (ছবি সংগৃহীত)

Photo of দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামের পৌরাণিক ইতিকথা এবং শিবরাত্রি যাপন... by Deya Das

শিবরাত্রির প্রাক্কালে শিব অর্চনা প্রসঙ্গে আলোচনায় দেওঘরের বৈদ্যনাথ মন্দিরকে কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দেওঘর জেলায় অবস্থিত এই মন্দিরটি ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ এবং ৫১টি সতীপীঠের মধ্যে অন্যতম ।

বৈদ্যনাথ ধাম সম্পর্কিত পৌরাণিক তথ্য

Photo of দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামের পৌরাণিক ইতিকথা এবং শিবরাত্রি যাপন... by Deya Das

কথিত আছে দশানন রাবন ভগবান শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। একদা রাবণের ইচ্ছা জাগে শিব এর স্থায়ী বাসস্থান কৈলাশ পর্বত থেকে লঙ্কায় স্থানান্তরিত করবেন । সেই উদ্দেশ্যেই রাবণ কৈলাশ পর্বত গমন করেন । কৈলাশে গিয়ে ভগবানকে তুষ্ট করার জন্য দীর্ঘ তপস্যা করেন। যেহেতু তিনি ভগবান শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, তাই ভগবানকে সন্তুষ্ট করার জন্য রাবন একটি করে মুণ্ডছেদ করে ভগবানের উদ্দেশ্যে সমর্পিত করেন । তবে প্রত্যেকবারই শিব রাবনের মুণ্ডটি যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে দিতেন ।

মন্দির প্রাঙ্গণ (ছবি সংগৃহীত)

Photo of দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামের পৌরাণিক ইতিকথা এবং শিবরাত্রি যাপন... by Deya Das

এই ঘটনার নবমতম পুনরাবৃত্তির পর ভগবান শিব তুষ্ট হয়ে বরপ্রাপ্তির প্রসঙ্গ এলে রাবণ তাঁর মনোবাঞ্ছার কথা বলেন । শিব রাবনকে আশীর্বাদ স্বরূপ সেই বর দেন, তবে সেটি ছিল শর্তসাপেক্ষে। ভগবান শিব-এর শর্ত ছিল কৈলাশ থেকে লঙ্কা যাত্রায় রাবণ শিব লিঙ্গকে কখনওই মাটিতে স্থাপন করতে পারবেন না। রাবন সেই শর্তে রাজি হয়ে লঙ্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন । কিন্তু অন্যান্য দেবতারা শিবের লঙ্কা যাত্রার ঘটনাটি মেনে নিতে পারেন না।

দেবতারা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেন, গঙ্গা রাবণের শরীরে প্রবেশ করবেন এবং শিবের লঙ্কা যাত্রার সমাপ্তি ঘটাবেন । কিছু পথ অতিক্রম করার পর রাবণ মূত্রবিসর্জনের জন্য একটি স্থানে খোঁজেন এবং পথচলতি একজন মানুষকে শিব লিঙ্গটিকে ধারণ করার জন্য অনুরোধ করেন। রাবণের শরীর থেকে জল নির্গমণ শেষ না হওয়ার কারণে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ায় সেই মানুষ শিবলিঙ্গকে মাটিতে স্থাপন করে দেন। পৌরাণিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাবনের শরীর থেকে জল নির্গমনের ফলে এখানে একটি জলাধার নির্মিত হয় যা বর্তমানে শিবগঙ্গা নামে পরিচিত এবং যেখানে শিবকে স্থাপন করা হয়েছিল সেটি আজ দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধাম ।

বৈদ্যনাথ ধাম মন্দিরের বিবরণী

Photo of দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামের পৌরাণিক ইতিকথা এবং শিবরাত্রি যাপন... by Deya Das

বৈদ্যনাথ মন্দির ভ্রমণে গেলে দেখা যায় প্রধান মন্দিরের সঙ্গে দেবী পার্বতীর মন্দির 'গাঁটবন্ধনে ' আবদ্ধ । এই দুই মন্দির লাল সুতোর দ্বারা আবদ্ধ, প্রকৃত অর্থে যা শিব এবং শক্তির মিলন । শিব পুরাণ অনুযায়ী বৈদ্যনাথ মন্দির আসলে দুই আত্মার মিলনস্থল, আর তাই বিবাহ সম্পাদনের জন্যও হিন্দুরা এই মন্দিরকে বেছে নেন । এই মন্দির প্রসঙ্গে মৎস্যপুরাণে উল্লেখ রয়েছে আরোগ্য বৈদ্যনাথ হিসেবে অর্থাৎ এই পবিত্রভূমিতে কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । একসময় সমগ্র দেওঘর রাজ্যের রাজা গিধাউর এই মন্দির নির্মাণের কাজে যুক্ত ছিলেন । পরবর্তীকালে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি এই মন্দির উন্নয়নের কাজে মনোযোগ দেন ।

বৈদ্যনাথ ধামে শিবরাত্রি পালন

শিবগঙ্গা (ছবি সংগৃহীত)

Photo of দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামের পৌরাণিক ইতিকথা এবং শিবরাত্রি যাপন... by Deya Das

পুরাতত্ত্ব অনুসারে শিবরাত্রি নিয়ে বিভিন্ন কাহিনির উল্লেখ রয়েছে । তবে দেওঘরে শিবরাত্রির উৎসবটা শিব এবং পার্বতীর বিবাহের দিন হিসেবেই গণ্য করা হয় । পুরাণে শিব-পার্বতীর বিবাহ নিয়ে বহু কাহিনি রয়েছে । এছাড়াও পুরাণে উল্লেখ রয়েছে এই বিবাহের দিনে সমস্ত দেব দেবী পশু রাক্ষসদের নিয়ে দেবতারা তাঁদের গৃহে প্রবেশ করেন । শিব এবং শক্তির অর্থ হল ভালবাসা, শক্তি এবং একাত্ম হওয়া। এই ধারণা কে কেন্দ্র করেই দেওঘরের শিবরাত্রি পালন করা হয় । আর সেই প্রথা অনুসারেই প্রত্যেক বছর শিবরাত্রির দিন প্রধান মন্দিরের সঙ্গে দেবী পার্বতীকে মন্দিরের গাঁটবন্ধনে আবদ্ধ করা হয়। এছাড়াও দর্শণার্থীরা শিবরাত্রির দিন এখানে পূজা অর্চনা করেন ।

বর্ণময় অনুষ্ঠানের ছোঁয়া (ছবি সংগৃহীত)

Photo of দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামের পৌরাণিক ইতিকথা এবং শিবরাত্রি যাপন... by Deya Das

তবে দেওঘরের শিবরাত্রির মূল আকর্ষণ হল শিবের বরযাত্রীর অনুষ্ঠান । ১৯৯৪ সাল থেকে এখানে বেশ জাক জমকের সঙ্গে নতুন করে ভগবান শিবের বিবাহ দেওয়া হয় ।

Photo of দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধামের পৌরাণিক ইতিকথা এবং শিবরাত্রি যাপন... by Deya Das

সন্ধ্যার সময় কাছাকাছি একটি স্টেডিয়াম থেকে এই যাত্রা শুরু হয়ে শহরের প্রধান স্থান হয়ে বৈদ্যনাথ মন্দিরে যাত্রার সমাপ্তি ঘটে । প্রতি বছর একটি থিম নির্দিষ্ট করে একজন মানুষকে ভগবান শিব সাজিয়ে গান বাজনা সহযোগে একধরণের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় । দেওঘরের এই 'বারাত ' দর্শনের জন্য বহু পর্যটকের সমাগম হয় ।

কোথায় থাকবেন

দেওঘরে অনেক ধরণের হোটেল উপলব্ধ আছে যার খরচ - ৭৫০ থেকে ৪০০০ এর মধ্যে ।

কীভাবে যাবেন -

ট্রেনে - হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে ৭ ঘণ্টার দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান জসিডি। স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৭ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে ।

সড়কপথে - কলকাতা থেকে সড়কপথে দুর্গাপুর - আসানসোল - ধানবাদ হয়ে দেওঘর পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ৮ ঘণ্টার মতো।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।