হিন্দু ধর্মের তীর্থস্থানগুলির মধ্যে উত্তরাখণ্ড রাজ্যটির উপস্থিতি সর্বাগ্রে। এই রাজ্যের হরিদ্বার থেকে শুরু করে চারধাম যাত্রা হিন্দুদের তীর্থযাত্রার ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের অনেকের কাছেই অজানা, এই রাজ্যে অবস্থিত দেবীর ১০৮ টি শক্তিপীঠের অন্যতম পীঠ পূর্ণগিরি মন্দির । বেশ কিছুদিন আগে আমি দেবী পূর্ণগিরি দর্শনের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। পূর্ণগিরি মন্দিরটি উত্তরাখণ্ডের চম্পাওয়াত জেলার টনকপুর থেকে মাত্র ১৭কিমি অদূরে অবস্থিত। চলুন ভ্রমণবৃত্তান্তটি জেনে নেওয়া যাক -
প্রথম দিন ট্রেনে চেপে পৌঁছে গেলাম টনকপুর। রাত্রিবাসের জন্য মন্দিরের কাছে একটি স্থানে পাহাড়ের কোলেই তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা যেখানে রাত্রিবাস করেছিলাম ঠিক তার পাশেই আর একটি তাঁবু খাটিয়ে খাবার সরবরাহের জন্য ভাণ্ডারা বানিয়েছিলাম। রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম । পরদিন ভোর ৪টে নাগাদ ঘুম থেকে পাহাড়ি জলে স্নান সেরে প্রসাদ নির্মাণের কাজ শুরু করলাম। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি আমাদের প্রসাদ হিসেবে ছিল সুজির হালুয়া এবং ছোলা।
আমাদের হিন্দু রীতি অনুযায়ী প্রসাদ বানিয়ে ভগবানের কাছে অর্পণ করার পরই ভাণ্ডারা অর্থাৎ প্রসাদ বিতরণ করা হয় তাই এত সকাল সকাল প্রসাদ নির্মাণের আয়োজন ।
এই মন্দির দর্শনের জন্য আপনাকে ৩-৪ ঘণ্টা ট্রেক করতে হবে । প্রায় ৫০০ টা সিঁড়ি বেয়ে মন্দির পৌঁছতে হয়, আমাদের পুজো দেওয়ার জন্য বেশ তাড়া ছিল, কারণ পুজো দিয়েই ভাণ্ডারার আয়োজন করতে হবে ।
মন্দিরের রাস্তাটা সমতল না থাকায় প্রসাদ নিয়ে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হয়েছিল, প্রায় ৯০% রাস্তা অতিক্রম করে পাহাড়ি রাস্তা ধরার আগে আমরা কিছুক্ষণের হল্ট নিলাম । কিছুক্ষণের বিরতির পর আবার দেবী দর্শনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম । পাহাড়ের খাড়াই রাস্তা ধরে কিছু পথ অতিক্রমের পর সিঁড়ি রয়েছে । মন্দিরের প্রবেশের পথে সাধারণত বেশ লম্বা লাইনের ভিড় থাকে । আর এই অতিরিক্ত দর্শণার্থীদের সামলানোর জন্য এখানকার পুলিশের ওয়াকিবহাল । যেহেতু আমাদের কাছে প্রায় ১০-১২ কেজি ওজনের প্রসাদের সরঞ্জাম ছিল তাই স্থানীয় প্রশাসন ব্যাবস্থার সহযোগে ফাঁকায় ফাঁকায় দেবী পূর্ণগিরির দর্শন করে পুজো দিলাম ।
টনকপুর -
কুমায়ুন হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত টনকপুর শহরটি বিশেষত পূর্ণগিরি মন্দিরের জন্যই প্রসিদ্ধ। পাহাড়ে মোড়া এই শহরকে কেন্দ্র করে রয়েছে সারদা নদী।
পূর্ণগিরি মন্দির -
১০৮টি সিদ্ধপীঠের মধ্যে অন্যতম হলেন দেবী পূর্ণগিরি মন্দির। মন্দিরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। সারাবছর এই দেবী দর্শনের জন্য দর্শণার্থীর আগমন ঘটলেও চৈত্র নবরাত্রি তিথিতে সাড়ম্বরে এই দেবীর আরাধনা করা হয়।
কালি নদী -
মন্দির দর্শন করে মন্দির লাগোয়া কালি নদী দর্শনের সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাগ্যিস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম না হলে উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন এক্কেবারে মিস হয়ে যেত । পাহাড় দিয়ে ঘেরা চঞ্চলা নদীর বহমানতার রূপটা দেখতে অসাধারণ লাগল।
টনকপুর ড্যাম -
পুজো সেরে ফেরার পথে দিন দুয়েক সময় হাতে রেখেছিলাম পারিপার্শ্বিক স্থান পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে। তাই প্রথমেই পৌঁছে গেলাম নেপাল বর্ডার দর্শনে । আচ্ছা বলুন তো এতো কাছে আন্তর্জাতিক সীমান্ত অঞ্চল দর্শন করা কি কোনও ভাবে মিস করা যায়? নেপাল সীমান্ত দর্শন করে গাড়ি চেপে পৌঁছে গেলাম টনকপুর ড্যাম । এই স্থানটি কিন্তু বেশ নিলিবিলি এবং পরিচ্ছন্ন ।
সিদ্ধবাবা মন্দির -
টনকপুর ড্যাম পরিদর্শন করে পৌঁছে গেলাম সিদ্ধবাবা মন্দির। ভারত - নেপাল সীমান্তে অবস্থিত এই মন্দিরে ভগবান শিব বিরাজিত আছেন । দর্শণার্থীরা দেবী পূর্ণাগিরিকে দর্শন করার পর সিদ্ধবাবা মন্দির দর্শন করেই এই যাত্রাটি সম্পন্ন করেন ।
এই জায়গাটি পরিদর্শনের পর মুখ্য দুইটি অভিজ্ঞতা আমার পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই -
১. আগে আমি যতবার এই মন্দির দর্শনে এসেছি, আমি দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর ও ভালভাবে দেবীকে দর্শন করতে পাইনি । তবে এই প্রসাদ নিয়ে যাওয়ার ফলে খুব ভাল ভাবে দেবীর দর্শন পেয়েছি এবং পুজো সম্পন্ন করেছি ।
২. এই যাত্রার সাথে উপরিপাওনা হিসেবে নেপালে বর্ডারে ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছি । এক্ষেত্রে কোনও ভিসার প্রয়োজন ও হয়নি, বর্ডারে পুলিশরা শুধুমাত্র কিছু সই সাবৎ করে আমার সঙ্গে থাকা ব্যাগটি চেক করে আমায় নেপাল বর্ডার দর্শনের অনুমতি দিয়েছিলেন ।
মন্দির দর্শন করার পর এবার ট্রেন ধরার পালা। ট্রেনে চেপে ফিরে এলাম বাড়িতে ।হরিদ্বার, দেরাদুন কিংবা উত্তরাখণ্ডের যে কোনও স্থানে ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই টনকপুর পরিদর্শন করে নিতে পারেন । এই শহর পরিদর্শন করার জন্য আপনি ট্রেনে এবং সড়কপথে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন।
ট্রেনে - উত্তরাখণ্ডের যে কোনও বড়ো স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে পৌঁছে যেতে পারেন টনকপুর জংশন। স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যান গন্তব্যে ।
সড়কপথে - উত্তরাখণ্ডের যে কোনও শহর থেকে বাসে কিংবা গাড়ি চেপে পৌঁছে যান টনকপুর। সেখান থেকে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে পৌঁছে যান পূর্ণগিরি মন্দিরে।