বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিবৃত্ত, যা আপনাদেরও মুগ্ধ করবে...

Tripoto
Photo of বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিবৃত্ত, যা আপনাদেরও মুগ্ধ করবে... 1/8 by Deya Das
মন্দিরের বাইরের অংশ (ছবি সংগৃহীত)

প্রখ্যাত কবি পিনাকী ঠাকুর এবং নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভিটে বাঁশবেড়িয়ার কথা অনেকেরই জানা। তবে শুধু সাহিত্যপ্রেমীরা নন, ভ্রমণপ্রেমীরাও এখানে আসেন এই জায়গার ইতিহাস জানার আগ্রহে। ঠিক সেই রকমই বাঁশবেড়িয়ার একটি বিখ্যাত জায়গা হল হংসেশ্বরী মন্দির। এই মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই জায়গার রাজপরিবারের অনেক কাহিনি। তাহলে দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক সেই কাহিনি-

রাজপরিবারের কাহিনি এবং বাঁশবেড়িয়ার নামকরণ-

Photo of বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিবৃত্ত, যা আপনাদেরও মুগ্ধ করবে... 2/8 by Deya Das
মন্দিরের ভিতরের অংশ (ছবি সংগৃহীত)

বর্ধমানের পাটুলি ছিল বাঁশবেড়িয়া রাজপরিবার দত্তরায়দের আদি নিবাস। মুঘল সম্রাট আকবরের কাছ থেকে এই রাজপরিবার রায় উপাধি পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে মজুমদার উপাধি লাভ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সেই সময় মজুমদার উপাধিতে ভূষিত মাত্র চারটি পরিবারের মধ্যে কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারের সদস্য ভবানন্দের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে এই দত্তরায় পরিবারের আদিপুরুষ রাঘব দত্তরায় মুঘল সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে সাতগাঁও, বর্তমানে যার নাম সপ্তগ্রামের ২১টি পরগণার জমিদারির জায়গীর লাভ করেছিলেন। এরপর রাঘব দত্তরায়ের পুত্র রামেশ্বর দত্তরায় বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৩৬০টি পরিবার নিয়ে বংশবাটীতে চলে আসেন। এরপর দিল্লির সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে রাজস্ব ব্যবস্থা প্রণয়ন সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সম্রাট খুশি হয়ে রামেশ্বরের পরিবারকে রাজা-মহাশয় উপাধিতে ভূষিত করেন। এর কিছুদিন পর বাঁশবেড়িয়ায় বর্গী আক্রমণর ফলে শ্মশানে পরিণত হয়। এই সময় রাজা রামেশ্বর বর্গী আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য একটি বাঁশবন পরিষ্কার করে মাইল খানেক জায়গা জুড়ে পরিখা বেষ্টিত একটি দুর্গ নির্মাণ করেন; তারপর থেকে এই জায়গার নাম হয় বাঁশবেড়িয়া। তবে লোকমুখে এই দুর্গটি গড়বাটী নামে প্রসিদ্ধ।

মন্দিরের ইতিহাস

Photo of বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিবৃত্ত, যা আপনাদেরও মুগ্ধ করবে... 3/8 by Deya Das
হংসেশ্বরী মন্দির (ছবি সংগৃহীত)

রাজা রামেশ্বর রায়ের প্রণাম প্রপৌত্র নৃসিংহদেব রায় বাঁশবেড়িয়া হংসেশ্বরী মন্দির নির্মাণকার্য শুরু করেন। এরপর সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই পরিবর্তন হতে থাকে। নৃসিংহ দেবের পিতা গোবিন্দ দেবের মৃত্যু হলে তাদের জমিদারি বেশ কিছু অংশ হাতছাড়া হয়ে যায়।

পরবর্তীতে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরে ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হয়। কিন্তু ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে নৃসিংহদেব মারা যান। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে নৃসিংহদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী রাণী শঙ্করী অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করেন। মন্দিরটি তৈরীর জন্য উত্তর প্রদেশের চুনার থেকে পাথর এবং রাজস্থানের জয়পুর থেকে কারিগরদের নিয়ে আসা হয়।

Photo of বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিবৃত্ত, যা আপনাদেরও মুগ্ধ করবে... 4/8 by Deya Das

উত্তর রাজস্থানের শেখাওয়াতি হাভেলি নির্মাণশৈলীর ধারা লক্ষ্য করে এই মন্দিরটি স্থাপত্য কারুকার্য করা হয়। প্রায় ৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয় মন্দির নির্মাণে। ৭০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দক্ষিণমুখী এই হংসেশ্বরী মন্দিরের সামনে রয়েছে বারান্দা ও ইটের বাঁধানো চত্বর। পাঁচতলা মন্দিরটির আটকোণে ৮টি, মধ্যস্থলে ৪টি, কেন্দ্রস্থলে ১টি অর্থাৎ মোট ১৩টি চূড়া রয়েছে। মধ্যস্থলে চূড়ার নিম্নাংশের প্রকোষ্ঠে একটি সাদা রঙের শিবলিঙ্গ রয়েছে। প্রত্যেক চূড়ার শীর্ষভাগ মোচাকৃতি পদ্মকোরকরূপী।

Photo of বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিবৃত্ত, যা আপনাদেরও মুগ্ধ করবে... 5/8 by Deya Das

জানা যায়, তান্ত্রিক সাধনা ষটচক্রভেদের তত্ত্বকে অনুসরণ করে এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। মানবদেহে সুষুম্নাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ইড়া, পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না এবং চিত্রিণী নামে মোট পাঁচটি নাড়ী রয়েছে। সুষুম্নাকাণ্ড বরাবর বিভিন্ন স্থানে ৬টি চক্র রয়েছে, যার মধ্যে সর্বনিম্ন চক্রটির নাম মূলাধার চক্র। এই মূলাধার চক্রের রয়েছে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনী। রাজা নরসিংহ দেব এই কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্বকেই হংসেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য কারুকার্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

Photo of বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিবৃত্ত, যা আপনাদেরও মুগ্ধ করবে... 6/8 by Deya Das
ভিতরের কারুকার্য (ছবি সংগৃহীত)

আরেকটু ভালো করে ব্যাখ্যা করলে হয়তো ব্যাপারটা বোঝা যাবে। মন্দিরের গর্ভগৃহকে ধরা হয় মূলাধার। আর এই মূলাধারে সহস্রদল নীলপদ্মের উপর রয়েছে অষ্টদল পদ্ম। তার ঠিক উপরে ত্রিকোণ বেদীর রয়েছেন মহাকাল। মহাকালের হৃদয় থেকে উঠে আসা দ্বাদশ দল পদ্মের ওপর এক পা মুড়ে কুণ্ডলিনী শক্তিরূপে বিরাজ করছেন দেবী হংসেশ্বরী মাতা। আর মানবদেহে প্রধান পাঁচটি নাড়ীর মতো মন্দিরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে পাঁচটি সিঁড়ি। এই সিঁড়ি গুলির মধ্যে যে কোনও একটি সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেলে রয়েছে এক বিচিত্র গোলক ধাঁধা যার মধ্যে খুব সহজে যে কেউ হারিয়ে যেতে পারেন। গোলক ধাঁধার একপাশে নিভৃত প্রকোষ্ঠে রয়েছেন শ্বেতপাথরের শৈব মূর্তি।

Photo of বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিবৃত্ত, যা আপনাদেরও মুগ্ধ করবে... 7/8 by Deya Das

হংসেশ্বরী দেবী মূর্তিটি নিম কাঠ ও নীল বর্ণের প্রতিমাটি দ্বারা নির্মিত এবং মহাকাল মূর্তি পাথরের তৈরি। কার্তিক মাসের অমাবস্যার দীপান্বিতা তিথিতে এই দেবীর পূজা করা হয়। এই অমাবস্যার রাতে দেবীকে এলোকেশী রূপে সন্ধ্যা আরতির পর সোনার জিভ, রুপোর মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের ডান হাতে রয়েছে অভয়মুদ্রা আর শঙ্খ এবং বাম হাতে খড়গ ও নরমুণ্ড। পুজোর সময় গায়ের বস্ত্র খুলে পরানো হয় ফুলের অলংকারের সজ্জিত রাজবেশ। সারাবছর হংসেশ্বরী মাতা দক্ষিণা কালিকা মতে পূজিত হলেও এই একটি দিন তান্ত্রিক মতে মায়েরপুজো করা হয়।

Photo of বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরের ইতিবৃত্ত, যা আপনাদেরও মুগ্ধ করবে... 8/8 by Deya Das
হংসেশ্বরী মন্দিরের দেবী (ছবি সংগৃহীত)

কীভাবে পৌঁছাবেন-

হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকালে চেপে বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে নেমে সেখান থেকে টোটো করে মন্দির যাওয়া যায়। এছাড়াও হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল পৌঁছে ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে মিনিবাস বা অটো করেও পৌঁছনো যায়।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।

Further Reads