কখনও কখনও অবসর সময় ইতিহাস বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এমন কিছু বিষয় চোখের সামনে এসে ধরা দেয়, যাকে এড়িয়ে পরের পৃষ্ঠায় চোখ রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। তার মধ্যে অন্যতম হল রাজা মহারাজাদের কার্যকলাপ। সেই সমস্ত মহারাজাদের বিভিন্ন কাহিনি পড়তে পড়তে সময় যেন হঠাৎ করে থমকে যায় আর মন চলে যায় কোনও এক ঐতিহাসিক যুগে। শতাব্দী প্রাচীন বিভিন্ন অজানা তথ্য, পুথি, লিপি থেকে তখনকার রাজবাড়ির অন্দরমহল, বাহিরমহল, নাচঘর, শয়ন কক্ষ সবকিছুই যেন চোখের সামনে এসে যখন ধরা দেয়, ঠিক তখনই মনে হয় এই সমস্ত রাজবাড়ি ঘোরার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারলে কেমন হয়?
তাই রাজবাড়ি পর্বে আজ আমরা ‘ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির’ গল্প শুনব...
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি ইতিহাস:-
১৫৭০ সালে মুঘল সম্রাট আকবরের আদেশে রাজস্থানের তৎকালীন রাজা সর্বেশ্বর সিং চৌহান বাংলায় আসেন আধিপত্য বিস্তার করতে। সেই সময় ঝাড়খণ্ডে শাসনকার্য চালাতেন মল্ল শাসকেরা। তখন এই রাজ্যের নাম ছিল ঝাড়িখণ্ড। রাজা সর্বেশ্বর সিং চৌহান মল্লদের রাজাকে পরাজিত করে উপাধি নেন ‘মল্লদেব’ এবং এক নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এই রাজবংশের ১৮ জন রাজা প্রায় ৪০০ বছর ধরে শাসনকার্য চালান।
১৯২২ সালে এই রাজবাড়িটির নির্মাণ পর্ব শুরু হয় এবং যা শেষ হয় ১৯৩১ সালে। প্রায় ৭০ বিঘা জমির উপর স্থাপিত ইটালিয়ান ও ইসলামিক স্থাপত্য শৈলী দ্বারা নির্মিত এই রাজবাড়িটি পর্যটকদের কাছে একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান।
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি কিছু অজানা তথ্য:
আউট হাউস -
• ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশের পর বাঁদিকে রয়েছে একটি আউট হাউস।
• সিঁড়ি দিয়ে উঠে এই আউট হাউসের অন্দরমহলে প্রবেশ করলে দেখতে পাওয়া যায় প্রাচীন ইতিহাসের প্রচুর নিদর্শন ।
• এই আউট হাউসে একসময় লর্ড উইলিংটন, প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, বিধান চন্দ্র রায়, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং মহানায়ক উত্তম কুমার-এর মতো গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাঁদের পদধূলি দিয়েছেন।
• আউট হাউসের সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই চোখে পরবে বসার ঘর, যার দেয়ালে অঙ্কিত রয়েছে ১০০ বছরের পুরনো নকশা।
• বসার ঘরে ঠিক দু পাশে রয়েছে দুটি বেশ বড় ধরনের শয়ন কক্ষ।
• শয়ন কক্ষে সজ্জিত রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন আসবাবপত্র।
এই আউট হাউস থেকে বেরিয়ে ডান দিকে তাকালে দেখা যায় ফোয়ারা এবং সামনে ফুলের বাগান। ফুলের বাগানের ঠিক পিছনে রয়েছে রাজবাড়ি।
রাজবাড়ির অন্দরমহল
• ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন ও রাজপরিবারের যৌথ প্রয়াসে বর্তমানে রাজপ্রাসাদের সর্বনিম্ন তলাকে ‘হেরিটেজ হোটেল’- এ রূপান্তরিত করা হয়েছে।
• প্রাসাদের দ্বিতলের এখনও মল্লদেব রাজবংশের বর্তমান সদস্যরা অবস্থান করেন।
• অন্দরমহলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে রাজবংশের বেশ কিছু পুথিপত্র এবং ছবি দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে প্রাক্তন রাজাদের কর্ম-কাহিনি বর্ণিত রয়েছে।
• প্রাসাদের নীচতলায় অতিথি আপ্যায়নের জন্য রয়েছে এক বিশাল ডাইনিং হল। যেখানে আগত অতিথিকে রাজবাড়ির পুকুরের মাছ এবং রাজবাড়ির ধারায় সুপক্কভাবে তৈরি রান্না পরিবেশন করা হয়।
• পর্যটকদের জন্য এই রাজবাড়ির নীচের তলার অংশটিতে রয়েছে ১৪ টি বিভিন্ন রকম ঘরের ব্যবস্থাপনা। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল-
১. ক্লাসিক ডিলাক্স।
২. রয়েল ফ্যামিলি ডিলাক্স।
৩. রয়েল ফ্যামিলি সুইট।
৪. রয়েল এক্সিকিউটিভ ফ্যামিলি সুইট।
৫. মহারাজা সুইট।
• তবে এই রাজপ্রাসাদের পিছনে রয়েছে প্রায় ৩৫০ বছরের পুরনো ঝাড়গ্রামের আসল রাজবাড়ি। যেখানে বর্তমানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে মূল রাজবাড়িটি ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট-এর নকশায় তৈরি।
রাজপ্রাসাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল-
• রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে কিছুটা গেলেই রয়েছে রাজবাড়ির কুল দেবতা রাধারমনের মন্দির। যেখানে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি এবং তার পাশেই রয়েছে শিব মন্দির।
• মন্দিরের চূড়ায় রয়েছে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দিক নির্দেশকারী চক্র।
• মন্দিরের পিছনে রাখা আছে প্রাচীন পালকি এবং মুগুর, যেগুলি পুরনো দিনের কথা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে।
কথায় বলে বাড়ি তৈরির প্রতিটি ইটে লুকিয়ে থাকে রহস্য আর ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই এই রহস্য উন্মোচন করতে শতাব্দী ধরেই বিভিন্ন পরিচালকেরা ক্রমশ এই জায়গাটিকে তাঁদের চলচ্চিত্রে প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নির্বাচিত করে আসছেন। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি অন্দরমহল এবং পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে যে সমস্ত বাংলা চলচ্চিত্র উপস্থাপনা করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম
১. পীযূষ বোসের সন্ন্যাসী রাজা, বাঘ বন্দী খেলা।
২. সন্দীপ রাযয়ের টিনটোরেটোর যীশু।
৩. ধ্রুব ব্যানার্জীর দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন; প্রভৃতি
রাজবাড়ি কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানানো হয় ‘সন্ন্যাসী রাজা’ চলচ্চিত্রের শুটিং-এর সময় উত্তম কুমার এই রাজবাড়িতে বেশ কিছুদিন ছিলেন। সেই সময় তিনি খাঁটি ভোজন রসিক মানুষ হওয়ার কারণে চিংড়ি মাছের মালাইকারি খাওয়ার জন্য উদ্যত হন, যার ফলে রাজবাড়ির একজন কর্মরত রন্ধন পটিয়সী তাঁকে নিজের হাতে এই চিংড়ি মাছের মালাইকারি রান্না করে খাইয়ে ছিলেন। যিনি বর্তমানে আজও রাজবাড়িতে রয়েছেন। এছাড়াও এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য যে সমস্ত পার্শ্ব চরিত্রগুলিকে নির্বাচন করা হয় যেমন- মালী, গাড়ির চালক এবং বাড়ির সমস্ত পরিচারকগণ তারা সবাই এই রাজবাড়ির নিজস্ব কর্মরত ব্যক্তি।
রাজবাড়ী পরিদর্শন-এর আদর্শ সময়:-
আপনি বছরের যে কোনও সময় এই ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে ঘুরতে আসতে পারেন। এই রাজবাড়িটি পর্যটকদের জন্য সব সময় খোলা থাকে। তবে শীতকালে গেলে এই রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে বিভিন্ন রকম ফুল এবং প্রাকৃতিক শোভা দেখতে পাওয়া যায়।
থাকবার জায়গা:-
ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে এসে আপনি অনায়াসে একটি বা দুইটি দিন কাটাতে পারবেন, কারণ এখানে থাকবার জন্য যথেষ্ট সুবন্দোবস্ত রয়েছে। একটু স্বল্প খরচে থাকতে চাইলে রাজবাড়ির আউট হাউসে থাকতে পারেন। আর যদি আপনার সাধ্যের মধ্যে হয়; তবে আপনি এই রাজবাড়ির অন্দরমহলে থেকে এখানকার ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখতে পারেন।
পথনির্দেশ:-
• হাওড়া থেকে আপনি ঝাড়গ্রামে পৌঁছানোর জন্য এক্সপ্রেস ট্রেন পেয়ে যাবেন। কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম পৌঁছোতে ট্রেনে সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট। আর ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে রাজবাড়ির দূরত্ব ৩ কিলোমিটার।
• এছাড়াও নিজস্ব গাড়িতে কলকাতা থেকে ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে মাত্র ৪ ঘণ্টায় ঝাড়গ্রামে পৌঁছনো যায়।
তাহলে দেরি না করে এই বছর আপনার ঘোরার তালিকায় ঝটপট যোগ করে ফেলুন ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি নাম। আর সেখানে গিয়ে রাজবাড়িতে থাকার এক অদ্ভুত অনুভূতি সাক্ষী করে তুলুন নিজেকে। রাজবাড়ি ছাড়াও আশেপাশের বেশ কিছু স্থান যেমন- ট্রাইবাল মিউজিয়াম, কনক-দুর্গা মন্দির, ছিলকিগড় রাজবাড়ি, ঝাড়গ্রাম চিড়িয়াখানা ইত্যাদি অনায়াসে ভ্রমণ করতে পারেন।