প্রাচীন শিবমন্দিরের বিস্ময়কর রহস্য - ইলোরার কৈলাস মন্দির...

Tripoto
Photo of প্রাচীন শিবমন্দিরের বিস্ময়কর রহস্য - ইলোরার কৈলাস মন্দির... 1/1 by Deya Das
অপরূপ শিল্প-ভাস্কর্য সমৃদ্ধ (ছবি সংগৃহীত)

ইতিহাসের বড় অদ্ভুত বিষয়, যার মধ্যে যে শুধু প্রাচীনত্বের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে এমন নয়; রয়েছে অনেক আত্মগোপন করা মুখোশধারী রহস্যপূর্ণ কাহিনি; যে কাহিনিগুলি শোনার পরে যে কোনও ইতিহাসপ্রেমী ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে সেই জায়গায় ভ্রমণের ইচ্ছা আরও দ্বিগুণ হয়ে উঠবে। আজ ঠিক তেমনই একটি রহস্যময় বিস্ময়কর জায়গার সন্ধান দেব, যেটির ভ্রমণবৃত্তান্ত কাহিনি ভবিষ্যতে কখনো হয়তো আপনার চাক্ষুষ দর্শনের লালসাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

কৈলাস মন্দির ঔরঙ্গবাদ:-

অবস্থান -

মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গবাদ থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সহাদ্রী রেঞ্জে অবস্থিত ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি, সবচেয়ে প্রাচীন প্রসিদ্ধ ইলোরা গুহায় স্থাপিত এই রহস্যময় প্রাচীন হিন্দু মন্দিরটি ‘কৈলাস মন্দির’ নামে পরিচিত।

ছবি সংগৃহীত

Photo of Kailasa Temple, Ellora, Maharashtra, India by Deya Das

ইলোরাতে পাথর কেটে মোট ৩৪টি গুহা বানানো হয়, যার মধ্যে ১৬ নম্বর গুহায় রয়েছে এই মন্দিরটি।

মন্দিরের গঠন

সাধারণত কোনও পাথরের গুহা খনন হয় বাইরে থেকে ভেতরের দিকে। এই কঠিন এবং জটিল পদ্ধতিকে বলা হয় ‘কাটিং মনোলিক পদ্ধতি’। কিন্তু ইলোরার ১৬ নম্বর গুহায় অবস্থিত কৈলাস মন্দির উপর থেকে নিচের দিকে পাথর কেটে নির্মাণ করা হয়, যা সত্যিই এক বিস্ময়কর ঘটনা। প্রথমে পাথরগুলি উপর থেকে কাটা শুরু হয় এবং মাঝখানে এক বিরাট আয়তাকার পাথরের চারিদিকে ১১০ ফুট গভীর গর্ত করা হয়। এরপর মাঝখানের ওই পাথরটিকে কেটে কেটে বিভিন্ন কারুকার্য এবং ভাস্কর্যের সমাহারে বানানো হয় এই কৈলাস মন্দির। মন্দিরটি তিনটি অংশে বিভক্ত যথা- গর্ভগৃহ, নন্দীমণ্ডপ ও মুখমণ্ডপ।

এমন অপরূপ শিল্প শৈলী সত্যিই অভূতপূর্ব (ছবি সংগৃহীত)

Photo of প্রাচীন শিবমন্দিরের বিস্ময়কর রহস্য - ইলোরার কৈলাস মন্দির... by Deya Das

আর্কিওলজিস্ট এবং জিওলজিস্টদের মতে, মন্দিরের নিচে আছে ভূমিগত গুহা। যেখানে যাওয়ার রাস্তা সাধারণ মানুষের জন্য এখন বন্ধ। আর ঠিক এই দরজার পিছনে আছে একটি সুরঙ্গ পথ, যেটি অনুসরণ করে মানুষ একটি ভূগর্ভস্থ শহরে পৌঁছে যেতে পারেন। সাধারণত পর্বতের গুহায় অবস্থিত মন্দিরগুলি পাথর কেটে জোড়া লাগিয়ে নির্মাণ করা হয়; কিন্তু এই মন্দিরের গায়ে খোদাই করা কারুকার্য প্রমাণ করে একটি বড় পাথর কেটে এই মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। তবে মন্দির নির্মাণের সঠিক সময় সম্পর্কে কেউ তেমন অবগত নয়। কারও কারও মতে এটি প্রায় ১৯০০ পুরনো মন্দির আবার কেউ বলেন এটি তারপরও তৈরি হয়েছে। এই কৈলাস মন্দিরের বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করার জন্য ভূমিগত নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

কৈলাস মন্দিরের রহস্য:-

ভক্তবৃন্দের সমাবেশ (ছবি সংগৃহীত)

Photo of প্রাচীন শিবমন্দিরের বিস্ময়কর রহস্য - ইলোরার কৈলাস মন্দির... by Deya Das

কৈলাস মন্দিরের রহস্য আজও উদঘাটন করা সম্ভব হয় নি। এই মন্দির নির্মাণ এবং মন্দির বেশ কিছু ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্প আজও প্রত্নতাত্ত্বিকদের বেশ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্কিওলজিস্টদের মতে এই ধরনের পাথর কেটে মন্দির বানানোর জন্য প্রায় ৩ লক্ষ টনের কাছাকাছি পাথর কেটে সরাতে হয় এবং তা তৈরি করতে মোটামুটি ১২ লক্ষ বছর সময় লাগাবার কথা। কিন্তু ইতিহাস বলছে, কৈলাস পর্বত মাত্র ১৮ বছরের নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রচলিত আছে, রাষ্ট্রকূট রাজা প্রথম কৃষ্ণের সময় ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে ৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ১৮ বছরের মধ্যেই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ ১৮ বছরে ৩ লক্ষ টন পাথর কাটা হয়। তাহলে হিসাব করে দেখা যাচ্ছে ১৮ বছরে ৩ লক্ষ টন পাথর কাটলে বছরে প্রায় ১৬ হাজার টন পাথর কাটা হয়েছিল।

আর বছরে ১৬ হাজার টন পাথর কাটা মানে প্রতিদিন ৪৪ টন করে পাথর কাটা হয়। যদি একজন শ্রমিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১১ ঘণ্টা কাজ করেন, তাহলে প্রতি ঘণ্টায় ৪ টন করে পাথর কাটা হয়েছে। এবার প্রশ্ন থেকে যায় তাহলে এই ১৯০০ বছরের পুরনো মন্দিরটিকে শুধুমাত্র ছেনি হাতুড়ি দিয়ে পাথর কেটে কীভাবে এত তাড়াতাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব?

পাথর কেটে শিল্পের নিপুণতা (ছবি সংগৃহীত)

Photo of প্রাচীন শিবমন্দিরের বিস্ময়কর রহস্য - ইলোরার কৈলাস মন্দির... by Deya Das

অপরদিকে, পাথর কেটে যে পাথরগুলি বার করা হয়েছিল তার অবশেষ অংশগুলি এই মন্দিরের আশেপাশে অথবা কয়েকশো মাইলের মধ্যে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। এদিকে তখন ক্রেন বা কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকেও পাথর কাটা বা পাথর সরানো প্রায় অসম্ভব। তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, তাহলে কীসের সাহায্যে এত বড় বড় পাথর কেটে ও সরিয়ে হঠাৎ করে কীভাবে এই মন্দির এত কম সময়ের মধ্যে গড়ে উঠল?

আবার একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই বড় বড় আকৃতির স্তম্ভগুলি এবং মন্দিরের গায়ে, ছাদে, সিঁড়িতে, থামে যে সমস্ত কারুকার্য ও ভাস্কর্য-স্থাপত্য শিল্পের নমুনা দেখা যায় সেগুলি মানব দ্বারা নির্মিত বলে মনে হয়। তাহলে এর থেকে আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসে । সামান্য কিছু পাথরের যন্ত্রপাতি দিয়ে, কোন ব্লুপ্রিন্ট বা কম্পিউটারাইজড অতি উচ্চমানের নকশা ছাড়া এই মন্দির রাতারাতি এমনভাবে গড়ে উঠল, যার গঠন অস্তিত্ব সম্পর্কে আজও বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার এবং আর্কিওলজিস্টরা কোন সমাধান খুঁজে বের করতে পারেন নি। অনেকে আবার বলেন অ্যানসিয়েন্ট অ্যাস্ট্রোনট থিওরি অনুযায়ী, এই মন্দিরের নির্মাণ এলিয়েন প্রযুক্তিতে করা হয়েছে। তবে এটি সম্পূর্ণ প্রমাণ সাপেক্ষ।

শিল্পের নৈপুণ্য (ছবি সংগৃহীত)

Photo of প্রাচীন শিবমন্দিরের বিস্ময়কর রহস্য - ইলোরার কৈলাস মন্দির... by Deya Das

১৬৮২ সালে তৎকালীন রাজা ঔরঙ্গজেব প্রায় ১০০০ জন সৈন্যের দল পাঠিয়ে এই মন্দিরটিকে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। এই ১০০০ জন সৈন্য প্রায় ৩ বছর ধরে মন্দির ভাঙার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে, ঔরঙ্গজেব মন্দির ভাঙার নির্দেশ প্রত্যাহার করেন। তবে, এখান থেকেও একটি প্রশ্ন উঠে আসে। যদি এই মন্দিরটি মানুষের দ্বারাই নির্মাণ করা হয়, তাহলে কেন মানুষরাই এই মন্দিরটি ভাঙতে অসফল হয়েছিলেন?

পরিশেষে বলা যায়, এই মন্দিরের গঠন প্রকল্প সম্বন্ধে আজও কোন সঠিক তথ্য মেলে নি। তাই এই মন্দিরের নির্মাণকার্য নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের আজও সংশয় রয়েছে। তাহলে সত্যিই কী এই যুগের থেকে প্রাচীন যুগের মানুষরা আরও বেশি উন্নতশীল ছিলেন? না কি অন্য কোনওভাবে অতি উচ্চমানের পদ্ধতি ব্যবহার করে এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল? প্রশ্ন একটি নয়, প্রশ্ন একাধিক। তবে উত্তর এখনও অজানা।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।