ছেলেবেলায় রূপকথার গল্পগুলো মনে আছে? কোনও স্বর্গীয় পরিবেশে কোনও এক রাজার রাজত্বের কাহিনি বা কোনও পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বিশাল রাজ্যের অধিকারী কোনও রাক্ষস রাজার গল্প? সাধারণত এই ধরণের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করেই রূপকথার গল্পগুলো তৈরি হত | এই রূপকথার গল্পের বাস্তব প্রতিচ্ছবি পেয়ে যেতেই পারেন ভুটানে | ভুটানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে খালি চোখে দেখলে আপনার মনে হতেই পারে কোনও বিখ্যাত চিত্রকর তুলির টানে এই দেশটাকে নিজের হাতে সাজিয়ে তুলেছেন |পাহাড়ের গায়ে নানা রঙের কাঠের তৈরি ছোট ছোট বাড়ি, ভুটানের সংস্কৃতি, স্থানীয় মানুষের আতিথেয়তা; এই সমস্ত কিছু আপনাকে মুগ্ধ করবেই |
প্রথম আন্তর্জাতিক ভ্রমণ হিসেবে কেন ভুটানকেই বেছে নেবেন?
১. প্রথম বিদেশ ভ্রমণের জন্য ভুটানের থেকে সহজ গন্তব্য আর কিছুই হতে পারে না:
প্রথমবার বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে আমাদের সকলেরই অনেক রকম ছোট বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় | কিন্তু ভারতীয় ভ্রমণকারীদের ভুটানে ভ্রমণের জন্য যথেষ্ট সুবিধা রয়েছে | যার প্রথম কারণ টি হল ভারতীয় নাগরিক বিনা ভিসায় ভুটানে ভ্রমণ করতে পারেন | ভুটানের প্রবেশদ্বার পারো বিমানবন্দরে এবং ফুয়েন্টশোলিং-এর ইমিগ্রেশন অফিসে থেকে আপনি পেয়ে যাবেন ভুটান ভ্রমণের পার্মিট বা অনুমতিপত্র | ভুটান ও ভারত এর সীমান্তে অবস্থিত স্থানীয় দোকান থেকে কেনাকাটি করতে চাইলে পারমিট অফিস থেকে মানি-এক্সচেঞ্জ করে নিন, তবে সীমান্তে অঞ্চলে ভারতীয় মুদ্রার বিনিময়েও আপনি কেনাকাটি করতে পারেন | এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ভুটান ভ্রমণের জন্য পার্মিট এর সঙ্গে সঙ্গে ট্রাভেল ইন্সুরেন্সটিও কিন্তু যথেষ্ট প্রয়োজনীয় | এই ইন্সুরেন্সটির সাহায্যে বিনা বাধায় ভুটানের যে কোনও স্থান ঘুরে আসতে পারেন |
২. ভুটান ভ্রমণে কিন্তু বিশেষ কোনও ঝামেলা নেই:
শীতের সূচনার সময় অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসকে ভুটান ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় | তবে এই সময় ভ্রমণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে গরম জামাকাপড় ও সোয়েটার, জুতো, ওষুধ সামগ্রী যেমন ডিমোক্স (যা উচ্চতা থেকে অসুস্থতায় জন্য ব্যবহূত ওষুধ) সঙ্গে নিতে কিন্তু একদম ভুলবেন না | এছাড়াও, অন্তত ৬ মাসের বৈধতা যুক্ত পাসপোর্ট বা বৈধ ভোটার কার্ডটি সঙ্গে রাখবেন; এইগুলোর সাহায্যে সহজেই ভ্রমণের অনুমতি মিলে যাবে | অসুস্থতা বা অন্য যে কোনও সমস্যার কারণে যেমন বিমান বাতিল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ব্যাঘাত থেকে মুক্ত হতে ট্রাভেল ইন্সুরেন্সটি অবশ্যই হাতের কাছে রাখবেন|
৩. পারো বিমানবন্দরে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের শুভ সূচনা:
চারদিকে পাহাড়ে মোড়া ভুটানের পারো বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করা বেশ কঠিন কাজ |এখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র ৮ জন সুদক্ষ পাইলট-এর দ্বারা এখানে বিমানে যাত্রা সম্ভবপর হয় | বিমান অবতরণের জায়গাটি এতই ছোট যে অনেক সময় ওড়ার বা অবতরণের সময় পাহাড়ের সাথে বিমানের ডানাতেও ধাক্কা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় |
8. নিজে ড্রাইভ করেও ভুটানের ভ্রমণটা উপভোগ করতে পারেন:
আপনি যদি পার্বত্য অঞ্চল ও তার প্রকৃতির একনিষ্ঠ ভক্ত হন এবং এই অঞ্চলের সৌন্দর্যকে নিজের মতো করে উপভোগ করতে চান তাহলে ভুটান ভ্রমণের আগে থেকেই প্ল্যান করে নিন | নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে আপনার প্রতিবেশী দেশটি সঙ্গে পরিচয় করে নেওয়ার পরিকল্পনাটা কিন্তু মন্দ হবে না | ফুন্টশোলিং এই ইমিগ্রেশন অফিস থেকে আপনি আপনার গাড়ি সহযোগে ভ্রমণের অনুমতি পেয়ে যাবেন | তবে গাড়ির পারমিটের জন্য গাড়ির সমস্ত অরিজিনাল ডকুমেন্টস এবং আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্সটি প্রয়োজন হবে | আর ভুটান ভ্রমণের আগে হোটেল বুক করে আসাই ভাল |
৫. অ্যাডভেঞ্চারের নতুন স্বাদ পেতে ভারত- টু-ভুটান বাইকিং ট্যুর করতে পারেন:
ভারতের অনেক ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে যারা আপনার ভারত-ভুটান বাইকিং ট্যুরের ইচ্ছাটি পূরণ করতে পারে | প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল, এই বাইকিং ট্যুরের সূচনা হয় শিলিগুড়ি থেকে | ইচ্ছা করলে আপনি নিজেও এই বাইকিং ট্যুরের প্ল্যানটি ফলপ্রসূ করে ফেলতে পারেন | তবে ভুটানের রাজধানী থিম্ফু ও ভুটানের পূর্বের অঞ্চলগুলো ভ্রমণের জন্য আরও কয়েকটি প্রয়োজনীয় পারমিট সংগ্রহ করে দু-চাকায় সম্পূর্ণ ভুটান ভ্রমণ করে আসতে পারেন |
৬. স্থানীয় মানুষদের সুন্দর ব্যবহার ও আতিথেয়তা:
ভুটানিদের কাছে অতিথিরা হলেন ভগবানের সমতুল্য | ভুটানের মানুষের অতিথি সৎকার, সুমিষ্ট ব্যবহার, সরল জীবনযাত্রা ও তাদের সংস্কৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবেই | ভুটানে গেলে আপনার মনে হতেই পারে যে সর্বদা তাঁরা যেন নিজেদের প্রবেশদ্বারে প্রতীক্ষারত আছেন অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য | বিশেষত থিম্ফু ও পারো শহরের হোটেলের স্টাফ ও ভুমথাং অঞ্চলের মানুষের আন্তরিকতা এবং আতিথেয়তার জন্য ভুটান দেশটি একটা ধন্যবাদজ্ঞাপনের যোগ্য |
৭. এখানে এসে অপ্রকাশিত কৌতুকের মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠতে পারেন আপনিও:
জনসংখ্যার সাথে তুল্যমূল্য বিচারে এই দেশের প্রাণচঞ্চলতার মূল্য অনেক বেশি | এখানকার মানুষ চিন্তা, হতাশা এই সব দূরে রেখে তাদের আন্তরিকতা ও সারল্য নিয়ে খুশি থাকতেই ভালোবাসেন | আর তাই এই সহজ সরলমানুষগুলোর শিশুসুলভ স্বভাবের বশবর্তী হয়ে আপনি হঠাৎ করেই তাঁদের কাছে কোনও কৌতুকের মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠতে পারেন | আনন্দমুখরিত এই দেশটিতে টেলিভশনেরও সূচনা হয়েছে মাত্র কিছু শতাব্দী আগে | অনাবিল আনন্দে উচ্ছ্বসিত এই দেশটি তাদের নিজস্ব আনন্দ এবং প্রাণবন্ততা নিয়েই বরাবর মত্ত এবং এখনও ঠিক তেমন ভাবেই রয়েছে | ভুটানে বছরের প্রথম দিনটি এক্কেবারে অন্যরকম ভাবে উদযাপিত হয় | এই দিনটি ভুটানের বয়স্ক মানুষদের দিন হিসেবে পরিচিত | আর সেই প্রথা অনুসারেই এই দিনে ভুটানের সমস্ত বয়স্ক মানুষ একত্রে জন্মদিন পালন করেন |
৮. ভুটানের স্নিগ্ধতা ও শান্ত পরিবেশ আপনাকে আপন করে নেবে:
ভুটান দেশ টিকে একটু ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারবেন, এই দেশটি যেন নিজস্ব ছন্দের বন্ধনে আবদ্ধ | দেশের রাজধানী থিম্পুতে প্রচুর যানবাহনের যাতায়াত থাকলেও রাস্তাগুলো যানজটবিহীন, আর সবচেয়ে অবিশ্বাস্য হল এই এই দেশটির কোথাও একটিও ট্রাফিক লাইট আপনার চোখে পড়বে না | কেবলমাত্র এখানকার প্রধান রাস্তাগুলো কিছু ট্রাফিক পর্যবেক্ষক দ্বারা পরিচালিত | ভুটানে গাড়ির হর্ন বাজানো ও অধিক দ্রুততায় গাড়ি চালানো দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় | এখনও ভুটানের ৬০% অঞ্চল জঙ্গল ও পাহাড়ের পরিমণ্ডলে আবদ্ধ | ভুটান সরকার কর্তৃপক্ষ এই প্রাকৃতিকতায় আজীবন বিশ্বাসী থেকেছেন, আর তাই ভুটানের এই প্রাকৃতিক স্থাপত্যগুলোকে রক্ষা করে রেখেছেন প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য |
ভুটানে ভ্রমণ প্রসঙ্গে কয়েকটি তথ্য:
ভুটানের ভ্রমণকালে সর্বত্র প্রায়ই অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে, আর তাই কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন |
ভ্রমণকালীন সময়গুলিতে আপনার সঙ্গী হিসেবে হাতের কাছে রেখে দিন ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল ইন্সুরেন্সটিকে | যার সাহায্যে ভুটানের যে কোনও স্থানে যে কোনও সময়ে, এমনকী জরুরি অবস্থাতেও বিনা ঝামেলাতেই আপনি ভ্রমণ করতে পারবেন |
এছাড়াও, কয়েকটি স্থানীয় ভাষা যেমন “কুজুজ্যাংপো লা” অর্থাৎ “হ্যালো”, “কাদিনছেই” অর্থাৎ “ধন্যবাদ” এবং “তাশি দেলেক” অর্থাৎ “আপনি সুস্থ বা ভাল থাকুন” ইত্যাদি অভিবাদন জাতীয় শব্দ শিখে নিয়ে আপনি ভুটানের মানুষদের চমৎকৃত করতে পারেন |
এবার অযথা দেরি না করে চটপট বেড়িয়ে পড়ুন আর ঘুরে আসুন রূপকথার রাজত্ব থেকে |