বিষ্ণুপুর ভ্রমণের খুঁটিনাটি - চলুন ঘুরে আসি টেরাকোটার দেশ থেকে...

Tripoto

টেরাকোটা কাজের এক অপূর্ব শিল্প-শৈলী (ছবি সংগৃহীত)

Photo of Bankura, West Bengal, India by Aninda De

বিষ্ণুপুরের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি টেরাকোটা মন্দিরের হাত ধরে। তবে শুধু টেরাকোটা মন্দিরের কারুকার্য নয়, কলকাতা থেকে একটু দূরেই যে বিষ্ণুপুরের মতো একটা হেরিটেজ ডেস্টিনেশন আছে, তার জন্যে পর্যটক হিসেবে আমরা খুবই সৌভাগ্যবান। আসুন জেনে নেই ঐতিহ্যশালী বিষ্ণুপুর ঘুরতে যাওয়ার বিস্তৃত বিবরণী, যাতে আপনার পরের বিষ্ণুপুর ট্রিপে কিছু বাদ না পরে।

বিষ্ণুপুরের ঐতিহাসিক তাৎপর্য

ঐতিহাসিক রাঢ় বঙ্গের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিষ্ণুপুর। বিষ্ণুপুরের উত্থান শুরু হয় সপ্তদশ শতকে, রাজা আদি মল্ল রাঢ় অঞ্চলের রাজা হিসেবে মল্ল রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার পর। তার প্রায় ৩০০ বছর পরে দশম মল্লরাজা জগৎমল্ল বিষ্ণুপুরে নিজেদের সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তী প্রায় ৮০০ বছর ধরে মল্লরাজেদের শাসনে বিষ্ণুপুরের নানাবিধ উন্নতি হয় এবং এই সময় থেকেই সাংস্কৃতিক পীঠস্থান হিসেবে বিষ্ণুপুরের এগিয়ে চলা শুরু। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে বিষ্ণুপুরে নানা প্রাচীন মন্দির স্থাপন করা হয়, কিন্তু সেগুলোর কোনও অস্তিত্ব বর্তমান নেই। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে স্থাপিত টেরাকোটা নির্মাণশৈলীর মন্দিরগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং আজও আমরা এই মন্দিরগুলোকে দেখতে পাই। শুধু টেরাকোটা নয়, ল্যাটেরাইট পাথরের তৈরি বেশ কিছু মন্দিরও আছে। বাংলার মন্দিরশিল্পের বিভিন্ন নিদর্শন, যেমন চালা বা রত্নার প্রচলন এখানের বিভিন্ন মন্দিরে দেখা যায়।

টেরাকোটার দেশ বিষ্ণুপুর

বিষ্ণুপুর একটি মন্দিরপ্রধান হেরিটেজ ডেস্টিনেশন, তাই এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দর্শনীয় স্থানই ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরবিশেষ।

রাসমঞ্চ : ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত, বীর হান্বিরের শাসনকালে এই মঞ্চ বর্তমানে বিষ্ণুপুরের সবথেকে পুরনো স্থাপত্যের নিদর্শন। রাসমঞ্চের স্থাপত্যশৈলী অন্য সকল মন্দিরের থেকে আলাদা। সম্ভবত গোটা ভারতে এই শৈলীর অন্য কোনও নিদর্শন নেই। রাসের সময়, বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন মন্দিরের মূর্তি এই মঞ্চে নিয়ে আসা হয় এবং দর্শকরা ঘুরে দেখতে পারেন।

বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চ (ছবি সংগৃহীত)

Photo of বিষ্ণুপুর ভ্রমণের খুঁটিনাটি - চলুন ঘুরে আসি টেরাকোটার দেশ থেকে... by Aninda De

শ্যামরাই মন্দির : শ্যামরাই বা পঞ্চরত্ন মন্দির নামে পরিচিত এই মন্দিরটি বিষ্ণুপুরের সবথেকে বড়মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই মন্দিরের মাথায় পাঁচটি চূড়া বা রত্ন দেখা যায়। মন্দিরগাত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নানা গাথা টেরাকোটা শৈলীতে খোদাই করা আছে।

বিষ্ণুপুরের শ্যামরাই মন্দিরের ভাস্কর্য শৈলীর নিদর্শন (ছবি সংগৃহীত)

Photo of বিষ্ণুপুর ভ্রমণের খুঁটিনাটি - চলুন ঘুরে আসি টেরাকোটার দেশ থেকে... by Aninda De

কেষ্টরাই বা জোড়বাংলা মন্দির : টেরাকোটা শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল কেষ্টরাই বা জোড়বাংলা মন্দির। এই শৈলীতে মন্দিরের দুটি ভাগ পাশাপাশি অবস্থিত এবং প্রায় একইরকম দেখতে। মন্দিরে জোড়ার দেওয়ালগুলোতে রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্যও দেখা যায়।

জোড়াবাংলা মন্দিরের ছবি (সংগৃহীত)

Photo of বিষ্ণুপুর ভ্রমণের খুঁটিনাটি - চলুন ঘুরে আসি টেরাকোটার দেশ থেকে... by Aninda De

রাধাশ্যাম মন্দির : একরত্ন এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছে ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে, অঙ্গসজ্জায় ব্যবহৃত হয়েছে চুনাপাথর। মন্দিরের চার ধারে উঁচু প্রাচীর দেখা যায়।

রাধাশ্যাম মন্দির (ছবি সংগৃহীত)

Photo of বিষ্ণুপুর ভ্রমণের খুঁটিনাটি - চলুন ঘুরে আসি টেরাকোটার দেশ থেকে... by Aninda De

রসমঞ্চের আসে পাশে আছে আরো নানা বিখ্যাত মন্দির যেমন, রাধা লালিজু মন্দিরমৃন্ময়ী মন্দির । দেখতে পারেন গুমঘর এবং বড় ও ছোট পাথর দরজা। গুমঘর একটি ছোট টিলার ওপর অবস্থিত সুবিশাল বর্গাকার জানলাবিহীন এক কাঠামো, মনে করা হয়ে আগে এটি কারাদণ্ডাগার হিসেবে ব্যবহৃত হত। একসময় বিষ্ণুপুরের চারদিকে উঁচু প্রাচীর ছিল, শহরটিকে শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্যে। সেই দেওয়ালের সেরকম কিছু অবশিষ্ট নেই, ল্যাটেরাইট পাথরের তৈরি একটি বড় এবং একটি ছোট দরজা এখনও আছে, সেখানে তৎকালীন সৈন্যবাহিনী পাহারা দিত এবং শুধুমাত্র এই দরজাগুলো ব্যবহার করেই অধিবাসীরা বিষ্ণুপুরে যাওয়া আসা করতে পারতেন।

রাসমঞ্চের দক্ষিণে একটু এগিয়ে এলে দেখতে পাবেন বেশ কয়েকটি একরত্ন মন্দির, যাদের মধ্যে ছিন্নমস্তার মন্দিরটি জাগ্রত হিসাবে খ্যাত। এছাড়া কাছেই আছে নন্দলাল মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, রাধামাধব মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির ইত্যাদি। প্রতিটি মন্দিরের পিছনেই আছে স্থানীয় বিশ্বাস এবং লোকাচারের গল্প এবং প্রতিটি মন্দিরের স্থাপত্য এবং কারুকার্য একে অপরের থেকে আলাদা। তাই পর্যটকদের এখানে হাতে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে আসা উচিত।

মন্দিরগুলোর থেকে অল্প দূরে আছে ১৭৪২ সালে তৈরি বিশালাকার দলমাদল কামান। কথিত আছে বাংলায় মারাঠা আক্রমণের সময় রাজা মদনমোহন স্বহস্তে এই কামানের সাহায্যে মারাঠা বাহিনিকে পরাস্ত করেছিলেন।

বিষ্ণুপুরের সংস্কৃতি, লোকাচার এবং স্থানীয় শিল্পকলা

সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বিষ্ণুপুর বহুযুগ ধরেই পশ্চিমবঙ্গে অগ্রগণ্য। মন্দির বা ঐতিহাসিক স্থাপত্যকলা বাদ দিলেও, হ্যান্ডিক্রাফটস, টেক্সটাইল, বিভিন্ন রকম স্থানীয় মেলা ও পার্বণের মাধ্যমে বিষ্ণুপুরের নিজস্ব পরিচয় পর্যটকদের মনে জেলাটিকে আলাদা জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

টেরাকোটা শৈলীর ওপর ভিত্তি করে বিষ্ণুপুরের নিজস্ব হাতি এবং ঘোড়ার মূর্তি খুবই বিখ্যাত। একসময়ে এগুলি ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকলেও বর্তমানে তা শিল্পকর্মের নিদর্শন হিসেবেও সুখ্যাতি লাভ করেছে। পাঁচমুড়া, রাজগ্রাম, সোনামুখী বা হামিরপুর অঞ্চলের মৃৎশিল্পকলা বিখ্যাত। সোনামুখী এবং পাঁচমুড়ার মনসচালি, মা মনসার পূজাকর্মে ব্যবহৃত বিশেষ মাটির শিল্পকর্মও খুবই বিখ্যাত। এছাড়াও কাঠের, বাঁশের, তামার, পাথরের এবং পিতলের ওপরেও নানা কাজ করা হয়। স্থানীয় শিল্পীদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে জিনিসগুলো সংগ্রহ করা যেতে পারে।

বিষ্ণুপুরের তাঁত শিল্পীদের জ্ঞান এবং দক্ষতার প্রকাশ পাওয়া যায় এখানকার বালুচরী শাড়িতে, যা গোটা ভারতবর্ষে বিখ্যাত। বিভিন্ন স্থানীয় মন্দিরের দেওয়ালের পৌরাণিক নানা দৃশ্য এখানকার তাঁতিরা তাদের শাড়িতে ফুটিয়ে তোলেন। বালুচরী বাদে এখানকার স্বর্ণচরী এবং তসর সিল্কের শাড়িও খুব জনপ্রিয়।

বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন স্থানীয় উৎসব

দুর্গাপূজা কালীপূজা তো আছেই, কিন্তু বিষ্ণুপুরের ঘরোয়া ছোঁয়া পাওয়া যায় এক্তেশ্বরের চৈত্র গাজনের বা বেলিয়াতরের ধর্মরাজের গাজনের মেলায়। এছাড়াও রাস উৎসব, ভাদু এবং তুসু পুজোর সময়েও গোটা বিষ্ণুপুর নতুন করে সেজে ওঠে। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে মা মনসার উদ্দেশ্যে ঝাপন উৎসব পালন করা হয়, যা বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর অঞ্চলের আদিবাসী সংস্কৃতির অন্যতম জনউৎসব। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে রাজ্যসরকারের পক্ষ থেকে বিষ্ণুপুর মেলার আয়োজন করা হয়, শীতকালে গ্রামবাংলার এই মেলা সত্যিই দর্শনীয়।

কীভাবে পৌঁছাবেন

কলকাতা থেকে সড়কপথে বিষ্ণুপুর যেতে চাইলে এস্প্ল্যানেড থেকে প্রতিদিন ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাস ছাড়ে। সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। নিজ্জ্বস্ব গাড়ি করে কলকাতা থেকে ডানকুনি হয়ে দুর্গাপুর ও আরামবাগ হয়ে পৌঁছনো যায়। খড়গপুর, আসানসোল, বর্ধমান থেকেও যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভাল।

ট্রেনে করে বিষ্ণুপুর স্টেশনে নেমেও ভিতরে আসতে পারেন। নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট হল কলকাতার নেতাজি সুভাষ আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট।

কখন যাবেন

গরমকালে বিষ্ণুপুর না যাওয়াই ভাল, তাপমাত্রা খুবই বেশি থাকে। তবে বছরের অন্যান্য সময়ে, বিশেষত রাসের সময়, পুজোর সময় বা শীতকালে বিষ্ণুপুর উৎসবের সময় যেতে পারেন।

কী কী খাবেন

বিষ্ণুপুরে কোনও বড় রেস্টুরেন্ট বা নির্দিষ্ট কোনও বিখ্যাত খাবার দোকান সেভাবে নেই, কিন্তু ঘরোয়া ভাবে রান্না করা খাবারদাবার সব জায়গাতেই পাবেন। বিষ্ণুপুরের ম্যাচা সন্দেশ, প্যাঁড়া এবং পোস্তর বড়া বিখ্যাত, এবং সুযোগ পেলে অবশ্যই খেয়ে দেখা উচিত।

কলকাতা থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটারের ভেতর অবস্থিত বিষ্ণুপুর ইতিহাস এবং সংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক। এখানকার মানুষজন, তাদের সহজ সরল জীবনযাত্রা এবং তাদের নিজেদের ঐতিহ্যকে বজায় রেখে এগিয়ে চলা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ঘুরে আসুন বিষ্ণুপুর, খুঁজে পান ঐতিহাসিক সোনার বাংলার এক ঝলক।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যাবহার করুন