উত্তরাখণ্ডের গাড়ওয়াল হিমালয়ের উচ্চতম শৃঙ্গ নন্দাদেবী পর্বতমালা এই রোমহর্ষক কাহিনির প্রেক্ষাপট। সময়টা ১৯৬৫, রক্তাক্ত ভারত - চীন যুদ্ধের মাত্র ৩ বছর পরেই। আর ক্রীড়াঙ্গনে হাতে হাত মিলিয়ে নেমেছে ভারতবর্ষের ইন্টেলিজেন্স বিউরো এবং আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ওরফে সি.এই.এ।
উদ্দেশ্য? নন্দাদেবী পর্বতের শৃঙ্গে, ৭৮১৫ ফিট উচ্চতায় একটি নিউক্লিয়ার শক্তি দ্বারা চালিত সেন্সিং ডিভাইস বসানো। ঠান্ডা যুদ্ধের চূড়ান্ত এই সময়ে এই সেন্সিং ডিভাইসের প্রয়োজন চিনদেশের উপর নজরদারি করার জন্যে। কিছুদিন আগেই চিনা উৎক্ষেপণ করেছে তাদের প্রথম পারমাণবিক মিসাইল। সেই চিনের গতিবিধি নজরে রাখতে অবতারণা এই সেন্সিং ডিভাইসের।
কিন্তু সেন্সিং ডিভাইস মানে ৫০-৬০ কেজি ওজনের যন্ত্রপাতি, সঙ্গে এন্টেনা এবং স্নাপ (সিস্টেম ফর নিউক্লিয়ার অক্সিলারি পাওয়ার) জেনারেটর, আর জ্বালানি হিসেবে আলাদা ক্যানিস্টারে ভরে নিয়ে যাওয়া ৭টি প্রচন্ড মারাত্মক এবং প্রচন্ড তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম ক্যাপসুল।
এই সমস্ত কিছু নিয়ে উপরে ওঠার সময় ১৮ই অক্টোবর সৈন্য বাহিনীর উপরে নেমে আসে প্রচন্ড বরফঝড় ও তুষারপাত। প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহে তখন মরণাপন্ন অবস্থা। যন্ত্র এবং ভারতীয় সৈনিকদের প্রাণের মধ্যে চলছে লড়াই। এই অবস্থায় সৈনিকদের জীবনের ওপর জোর দেওয়া হয় এবং তাঁরা সমস্ত যন্ত্রপাতি ওই স্থানে ফেলে রেখে নিচে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
সেনাবাহিনির ডেটা অনুযায়ী ৭টি ক্যাপসুল প্লুটোনিয়াম হচ্ছে হিরোশিমার উপর আছড়ে পরামাণবিক বোমার প্রায় অর্ধেক তেজস্ক্রিয় পদার্থ। তাই ১৯৬৬ সালের মে মাসে পুনরায় অভিযান চালানো হয়, হৃত প্লুটোনিয়াম এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ খুঁজে পাওয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ পর্যন্ত যন্ত্রাংশগুলি কিছু কিছু খুঁজে পাওয়া গেলেও প্লুটোনিয়ামের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিগত ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে মারণ প্লুটোনিয়াম লুকিয়ে আছে হয়তো নন্দাদেবী পর্বতের কোন গহীন অগোচরে।
হাফ লাইফ বিচার করে দেখলে এই প্লুটোনিয়াম ক্যাপসুলগুলির আয়ু প্রায় ১০০ বছর অর্থাৎ এখনও কিন্তু সেগুলি যথেষ্ট বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ভিতর প্রায় ১২টি সরকারি অভিযান চালানো হয় যন্ত্রপাতি এবং প্লুটোনিয়াম পুনরুদ্ধার করার জন্যে। সে সময় প্লুটোনিয়াম নিয়ে কোনও খবর পাওয়া না গেলেও গল্পের উপসংহারের আগে রয়েছে একটি শেষ টুইস্ট।
১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে নন্দাদেবী পর্বতে একটি পর্বতারোহী দলকে অনুমতি দেওয়া হয় একটি পরিবেশ বিষয়ক সমীক্ষা করার জন্যে। তাঁরা বেশ কিছু স্যাম্পেল জিনিসপত্র খুঁজে পেয়ে নিচে নিয়ে আসেন। সেই সকল বস্তুর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় একটি গোল স্টিলের কেস, যা দেখতে অনেকটাই প্লুটোনিয়ামগুলির ক্যানিস্টারের মতো। তবে এই স্টিল কেসটি ছিল ফাঁকা, মনে করা হয় প্লুটোনিয়ামগুলি সম্ভবত সেই স্টিল কন্টেনার ভেদ করে পাহাড়ি পরিবেশে কোথাও ছড়িয়ে পড়েছে।
তাই প্লুটোনিয়াম সন্ধানে এই গ্রুপটি বেশ কিছুটা কাছাকাছি গেলেও, একথা বলা যায় যে তার পরে অন্য কোনও অভিযান এখনও প্লুটোনিয়াম খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ আর্মি বা ভারতীয় মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশনের কিছু হাতে গোনা নিষ্ফল অভিযান ব্যতীত বহু বছর ধরে নন্দাদেবী পর্বত আরোহণের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে পরিবেশ রক্ষার কারণে।
বিগত ৫০ বছরের উপর সময় ধরে তাই নন্দাদেবী পর্বতের বুকে আসতে আসতে করে বেড়ে চলেছে রহস্য। সত্যি কি সেই প্লুটোনিয়াম এখনো বরফের তলায় চাপা পরে আছে? থাকলে তার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ কি স্থানীয় নদীর জলের সঙ্গে মিশে সমতলের মানুষদের প্রাণসংশয় করতে পারে? নাকি কোনওভাবে তা হারিয়ে গেছে চিরতরেই এবং আসতে আসতে আমরা একদিন এই মারণরহস্য ভুলে যাব? উত্তর জানা নেই আমাদের, এই রহস্যের সমাধান তাই একমাত্র ভবিষ্যতের হাতেই।