কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও...

Tripoto
Photo of Cellular Jail Museum, Atlanta Point, Port Blair, Andaman and Nicobar Islands, India by Deya Das

আন্দামান ও নিকোবরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে ক্রমাগত হাতছানি দিয়ে ডাকে। ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তিদের জন্য আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কিন্তু একটি স্বপ্নের গন্তব্যস্থল। তবে চাঁদের গায়ে যেমন কলঙ্ক থাকে, ঠিক সেইভাবেই সমুদ্রের রানী সৌন্দর্য বর্ধনকারী আন্দামান নিকোবরেরও একটি কালো দিক রয়েছে, তা হয়তো অনেকের অজানা। কত স্বাধীনতা সংগ্রামী তাজা প্রাণ অকালে এই জায়গায় এসে হারিয়ে গেছে তার কোনও হিসেব নেই।

Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী’ কবিতাটি পড়ে হয়ত অনেকে এই ইতিহাসের কথা জানার ইচ্ছা মনে জন্মেছে। তাই সেই সমস্ত পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আজ আমরা কথা বলব আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বিখ্যাত জায়গা সেলুলার জেল সম্বন্ধে। প্রাথমিক ভাবে কারাগারের নাম শুনলে আমরা সকলেই একটু ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি, কিন্তু এই জেলটি দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে ইতিহাসের কিছু অমূল্য সময়ের সাক্ষী হতে।

সেলুলার জেলের গঠন-

Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das

১৮৯৬ সালে অক্টোবর মাস থেকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে এই কারাগার তৈরি করার কাজ শুরু হয়, এবং তা শেষ হয় ১৯০৬ সালে। মূলত ব্রিটিশ রাজকর্মচারী চার্লস জেমস ল্যাল এবং চিকিৎসক এ এস লেথব্রিজ-এর মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনায় এই সেলুলার জেল তৈরি হয়েছিল; যা তৈরি করতে মোট খরচ হয়েছিল ৫ লক্ষ ১৭ হাজার ৩২৫ টাকা। মায়ানমার থেকে লাল পোড়া মাটির ইট নিয়ে এসে তিনতলা কারাগারটি নির্মাণ করা হয়। এই কারাগারটি সাতটি ছোট-বড় শাখা আছে এবং মধ্যভাগে রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় টাওয়ার, যেখান থেকে কারাগারের রক্ষক সর্বদা পাহারা দিতেন এখানকার বন্দিদের উপর। সেখানে একটি ঘণ্টাও রাখা ছিল। কারাগার থেকে কোন বন্দি পালালে বা কোনরকম অসুবিধা বুঝলেই রক্ষক সেটি বাজাতেন। ৬৯৬ টি সেল বা প্রকোষ্ঠ দিয়ে তৈরি এই জেলে বন্দিদের প্রত্যেককে প্রত্যেকটি আলাদা ঘরে রাখা হত, তাই এটির নাম সেলুলার জেল। কারাগারটিকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল বন্দিরা যে কক্ষে নিজেদের আরদ্ধ করতেন সেখান থেকে অন্য জেলের পিছনের দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতেন না।

Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das

এইরকম করার কারণ ছিল যাতে তারা কোনভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করতে পারেন।কারাগারের প্রতিটি প্রকোষ্ঠের আয়তন ছিল ৪.৫ মিটার × ২.৭ মিটার আর প্রতিটি কক্ষের দেয়ালের ঠিক ৩ মিটার উপরে ছিল একটি করে ভেন্টিলেটর।

Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das
Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das

কারাগারের ইতিহাস-

Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das

সিপাহী বিদ্রোহের পর মূলত ইংরেজরা এই জেলটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে ১৮৯৬ সালের অনেক আগে থেকেই বন্দিদেরকে নিয়ে এসে আন্দামান ও নিকোবরের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন- রস আইল্যান্ড ইত্যাদি নির্জন দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হত। ১৯৪৭ সালের আগে বিপ্লবীদের জোর করে এই জায়গায় নিয়ে আসা হয়। বন্দিদের হাতে-পায়ে কড়া ও বেড়ি পড়িয়ে নিয়ে আসা হত। শুধু তাই নয়, তাদের ওপর ইংরেজরা অমানবিক নিষ্ঠুর অত্যাচার চালাতেন। সারাদিন ধরে তাদেরকে দিয়ে সরষে পিশিয়ে সেখান থেকে তেল নিষ্কাশন করানো হত। নারকেল ছাড়ানো, ছোবড়া বার করা, দড়ি তৈরি করা, ইংরেজদের ঘরবাড়ি নির্মাণ, বন্দর, রাস্তাঘাট এমনকি জেলেরও কাজকর্ম করানো হত। প্রতিদিন ৩০ পাউন্ড নারকেল তেল এবং ১০ পাউন্ড সর্ষের তেল তাদেরকে পিষে বের করতে হত। আর এটি না করতে পারলে চলত নির্মম অত্যাচার। শোনা যায়, সুশীল দাসগুপ্ত নামে একজন বিপ্লবী সারাদিন নারকেল ছাড়াতে ছাড়াতে তাঁর হাত দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে। তারপর তাঁর জল তেষ্টা পেলে ইংরেজরা তাঁকে জল না দিয়ে উপহাস করতে শুরু করে এবং তাঁকে বলা হয় সমস্ত কারাগারের লোকদের জন্য গিয়ে দূর থেকে জল নিয়ে আসতে হবে এবং সেই যাত্রাপথ ছিল অত্যন্ত কঠিন। যাত্রাপথে কাঁটা গাছ থাকায় তিনি সেখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জল তেষ্টায় ও কাঁটা গাছের আঘাতে প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন। এছাড়াও শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, বটুকেশ্বর দত্ত, বারীন ঘোষ প্রভৃতি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ হয় মারা গেছেন না হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ইন্দুভূষণ রায় নিজের জামা গলায় জড়িয়ে আত্মঘাতী হন এই জেলে। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত দু'বছর তাঁর জীবনের অমূল্য সময় এই জেলের নির্মম অত্যাচারে কাটিয়েছেন। এই সময় তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। সেই জন্য পরবর্তী সময়ে তাঁকে কারাগারে লুনাটিক ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশদের এই নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে ৩৩ জন স্বদেশী আন্দোলনের নায়ক অনশনে বসেছিলেন।তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মোহন কিশোর নমদাস, মহাভির সিংহ এবং মোহিত মৈত্র। যাঁদেরকে ব্রিটিশ শাসকরা বহু প্রচেষ্টার পর জোর করে খাবার খাওয়ালে তাঁরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন। এই কারাগারের অন্যতম বিখ্যাত একজন বন্দি ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথ নির্দেশক। ইউনাইটেড কিংডম-এ আইন নিয়ে পড়াশোনা করার সময় থেকেই তিনি ইন্ডিয়া হাউস এবং ফ্রী ইন্ডিয়া সোসাইটি বিভিন্ন মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময় তিনি ‘দ্যা ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইনডিপেনডেন্স’ নামে একটি বই লিখেছিলেন, যে কারণে তাঁকে ব্রিটিশরা গ্রেফতার করেছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে ৫০ বছরের জেল হেফাজতে রাখেন। তবে তিনি ১৯১১ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত এই জেলে কাটিয়েছেন। জেলখানার প্রাচীর খুব একটা উচ্চতা সম্পন্ন ছিল না। কিন্তু তবুও এখানকার কোন বন্দি সেটিকে অতিক্রম করে পালিয়ে যেতে পারতেন না। কারণ এই কারাগারটিকে সমুদ্রের উপর এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যে জেলখানা থেকে কয়েদি পালানোর চেষ্টা করলেই তাঁরা সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে পরতেন। আর সেই সমুদ্রে থাকত বিশাল হাঙ্গর। তাই জেলখানার মধ্যে থাকলে ব্রিটিশদের অত্যাচারে তাঁদের মৃত্যু ঘটত, আর জেলখানা থেকে বাইরে বেরোলেও হাঙ্গরের জন্য মৃত্যু অনিবার্য ছিল। এছাড়াও কারাগারের মধ্যে কেউ মারা গেলে তাঁর মৃতদেহ সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলা হত। সেই জন্যই এগুলিকে কালাপানির সাজা বলা হত। এইরকম বিভিন্ন অমানবিক ঘটনার সাক্ষী রয়েছে এই বিখ্যাত সেলুলার জেল।

Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das

কারাগারে অবস্থিত কিছু আকর্ষণীয় বস্তু-

সেলুলার জেলের গেট দিয়ে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে একটি বিশাল পিপুল গাছ, যেটি এই জেলের ইতিহাসের বহু কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে পুরনো গাছটি ভেঙ্গে যাওয়ার পর নতুন গাছ লাগানো হয়েছে। আর একটু এগিয়ে গেলে দু’দিকে রয়েছে দুটি স্বতন্ত্র জ্যোতি, যা ৩৬৫ দিন ২৪ ঘন্টা জ্বলতে থাকে। এটি ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন দ্বারা পরিচালিত। তৃতীয় তলা বিশিষ্ট এই কারাগারটির ভিতরে রয়েছে বিপ্লবীদের নামের তালিকা। বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ছবিসহ তাঁর কক্ষটি সজ্জিত রয়েছে। কারাগারটির ছাদ থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমন্বিত সমুদ্র, রস আইল্যান্ড দেখতে পাওয়া যায়।

Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das

তবে বর্তমানে এই কারাগারটি পুনঃনির্মাণের কাজ চলছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসলে বাইরে রয়েছে একটি আর্ট গ্যালারি। যেখানে আন্দামানের বিভিন্ন জায়গার ছবিসহ তথ্য রয়েছে এবং জেলের কয়েদিদের আত্মকথার বিবরণী লেখা রয়েছে ছবির নীচে। তারপাশেই রয়েছে মিউজিয়াম, যেখানে বন্দিদের নানারকম কার্যকলাপ নির্মিত মূর্তি এবং জিনিসপত্র শাস্তির পোশাক, কারাগারের পোশাক, তেল নিষ্কাশনের যন্ত্র রয়েছে। এছাড়া এখানে রয়েছে ফাঁসি ঘর,যেখানে একসঙ্গে তিন জনকে ফাঁসি দেওয়া যেত। তার পাশেই রয়েছে রান্নাঘর। এই রান্নাঘরে হিন্দু-মুসলিম কয়েদিদের জন্য আলাদাভাবে রান্নার ব্যবস্থা ছিল। এছাড়াও জল সরবরাহের জন্য ছিল একটি কুঁয়ো। রান্নাঘরের খাদ্যতালিকায় থাকত সেদ্ধ ভাত, রুটি এবং সবজি তা পরিবেশন করা হত জং ধরা লোহার দুর্গন্ধযুক্ত থালায়।

Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das
Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das
Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das
Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das

কারাগারের কিছু পরিবর্তন-

১৯৪৭সালের জাপান জেলার চারটি অংশ ভেঙে ফেলে বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে জি.বি.পন্ত হাসপাতাল যেখানে ৫০০ টি বেড এবং ৪০ জন ডাক্তার নিয়ে অসুস্থ ব্যক্তির শুশ্রূষা করা হয়।

তবে আন্দামানে যদি আপনি ঘুরতে যান সেলুলার জেল দেখার সঙ্গে সঙ্গে এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় এখানে অনুষ্ঠিত লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো' টি দেখতে ভুলবেন না। কারণ এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই কারাগারের ইতিহাসটি খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। পরিশেষে বলা, ভারতবর্ষ এবং উপমহাদেশীয় আন্দোলনের একটি অন্যতম মাইলস্টোন হল এই কারাগারটি।

Photo of কালাপানির কালো জগতে আজও হাহাকার শোনা যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও... by Deya Das

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।