কলকাতা শহরের বুকে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন এক মসজিদের ঐতিহ্য:নাখোদা মসজিদ

Tripoto
Photo of কলকাতা শহরের বুকে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন এক মসজিদের ঐতিহ্য:নাখোদা মসজিদ 1/1 by Never ending footsteps
নাখোদা মসজিদের কথা (ছবি সংগৃহীত)

কলকাতা শহরকে ঘিরে রয়েছে বহু প্রাচীন গল্প-গাথা, রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ইতিহাস, রয়েছে নানা ধরনের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক সূত্র, আদতে কলকাতা শহর যেন কোনও গুপ্তধনের বাক্স... যার মধ্যে আছে না জানি কতশত প্রাচীন ইতিহাসের তথ্যসূত্র। এই কলকাতা শহরের বুকেই রয়েছে বহু প্রাচীন স্থাপত্য-শিল্পের নিদর্শন। শৈল্পিক উৎকর্ষতা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক প্রকারের কেন্দ্রস্থল। সার্বভৌম এবং অখণ্ড ভারতীয় ঐতিহ্যের সূত্রটি মিশে রয়েছে এই শহরেরই আনাচে-কানাচে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই এই শহরের মধ্যে স্থান পেয়েছে বহু গথিক স্থাপত্যশিল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, ঠিক একইরকমভাবে কলোনিয়াল সম্রাজ্যের আগে এই কলকাতা শহরের বুকেই স্থান পেয়েছে ইসলামীয় স্থাপত্য-শিল্পরীতির বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন।

কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ

ইসলামীয় স্থাপত্য শিল্পের কথা বলা প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় কলকাতার মধ্যে অবস্থিত সুপ্রাচীন ‘নাখোদা মসজিদের’ কথা। মধ্য কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত জনপদ হল পোস্তা, বড়বাজার। এই বড়বাজার এলাকায় জাকারিয়া স্ট্রিট এবং রবীন্দ্র সরণির সংযোগস্থলে অবস্থিত এই ‘নাখোদা মসজিদ’। ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকেই অবশ্যই এটিকে কলকাতা শহরের সবথেকে প্রাচীন মসজিদ হিসেবে পরিচিতি দিতে চাইলেও আরও একটা বিষয় বলে নেওয়া প্রয়োজন এখন আমরা নাখোদা মসজিদের যে আদল বা কাঠামোটি দেখতে পাই সেটির নির্মাণ কিন্তু ১৯২৬ সালে। সুতরাং সময়ের বিচারে নতুন কাঠামোটির নির্মাণও প্রায় একশ বছরের কাছাকাছি বলা যেতে পারে...

ধারাবাহিক বিভিন্ন বিবৃতি এবং ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় নাখোদা মসজিদ তৈরির আগে ওই স্থানে একটি ছোট মসজিদ ছিল। পরবর্তী সময়ে অবশ্য আগ্রার সেকেন্দ্রাতে অবস্থিত আকবরের সমাধিসৌধের আদলে এই মসজিদ নির্মাণের একধরনের কর্মসূচি অনুসৃত হয়। এই মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রয়েছে কচ্ছের এক ছোট সুন্নি মুসলমান সম্প্রদায় কুচ্ছি মেনন জামাতদের। তথ্য অনুসারে এই সম্প্রদায়েরই অন্যতম প্রধান নেতা আবদুর রহিম ওসমান এই মসজিদ নির্মাণের কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আরও কয়েকটি কথা বলে নেওয়া যাক। কচ্ছের মেনন সম্পদ্রায় কলকাতায় পা রাখেন ১৮২০ সাল নাগাদ।

মেনন সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন চিনি এবং অন্যান্য বাণিজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত। তবে এর পাশাপাশিই অন্যান্য বিষয়ের প্রতিও তাঁদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ থেকেই এই মসজিদ নির্মাণের কাজে তাঁরা অংশগ্রহণ করে। মূলত তাঁরই উদ্যোগে মসজিদ নির্মিত হয়। এ নাখোদা মসজিদের নামকরণের ক্ষেত্রেও তাঁর জীবিকার একধরনের যোগসূত্র রয়েছে। ফার্সি শব্দ ‘নাখোদা’ বা ‘নাখুদা’ শব্দের অর্থ হল নাবিক, আবদুর রহিম ওসমানও ছিলেন একজন নাবিক।

মসজিদের ভাস্কর্য

ইসলামীয় স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল গম্বুজ এবং স্তম্ভের নির্মাণ। নাখোদা মসজিদের ক্ষেত্রেও কিন্তু আমরা বলতে পারি অনুরূপ শিল্পপ্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনটি গম্বুজ এবং দুটি মিনার রয়েছে এই স্থাপত্যে। মিনারগুলোর উচ্চতা প্রায় ১৫১ ফুট। আরও বলা যায় দুটি সুউচ্চ মিনার ছাড়াও অতিরিক্ত ২৫টি ছোট ছোট মিনার রয়েছে এই সৌধের মধ্যে। যেগুলোর উচ্চতা আবার ১০০ থেকে ১১৭ ফুটের মধ্যে। সুউচ্চ এবং সুপরিকল্পিত এই মসজিদে নামাজ ঘরে প্রায় ১০,০০০-এর বেশি মানুষ একত্রিত হতে পারেন। দিল্লির স্থাপত্য শিল্পের অনুকরণে যেহেতু এই মসজিদের নির্মাণ তাই এক্ষেত্রে ফতেপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজার অনুকরণে এই মসজিদের প্রবেশপথটি নির্মিত হয়েছে।

মসজিদের প্রস্তর ১৯২৬ সালে নির্মিত হলেও নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হতে বেশ কিছু বছর লাগে। ১৯৪২ সালে মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। অর্থগত পরিসংখ্যান অনুসারে এই মসজিদ নির্মাণে সেই সময়ে আনুমানিক ১৫,০০,০০০ টাকা ব্যয় হয়েছিল।

নাখোদা মসজিদের আশেপাশে

সময়ের সরণি বেয়ে ২০০৮ সালে রাজ্য সরকারের তরফে একে হেরিটেজ বিল্ডিং-এর আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই মসজিদের প্রাচীনত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঐতিহাসিকমহলে নানা আলোচনা উঠে এলেও মসজিদের আশপাশ ঘুরে দেখলে শাহী মেজাজ অনুভব করতে পারবেন। ঈদ এবং রমজান পরবের সময় এই মসজিদ এবং সংলগ্ন রাস্তার সৌন্দর্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। বিভিন্ন রকমের মশলা, আতর, সেমাই আরও অনেক কিছুর দোকান রয়েছে আশে-পাশে। সুতরাং, মোঘল আমলের আস্বাদ পেতে চাইলে বিনা দ্বিধায় চলে আসতে পারেন আপনিও...

পর্যটনকেন্দ্র রূপে উল্লেখযোগ্যতা

আরও একটি তথ্য উল্লেখ করতে হয় স্থাপত্যশৈলীর কারণে এটি এক উল্লেখযোগ্য পর্যটনক্ষেত্রও বটে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পর্যটকের জন্যই এই মসজিদে প্রবেশাধিকার রয়েছে। সকাল ৬ টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে মসজিদে আপনি প্রবেশ করতে পারবেন, ঐতিহাসিক এই ইমারতের গায়ে বয়ে চলা ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে পারবেন আপনি। প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনও প্রকার প্রবেশ মূল্য নেই।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।