ভারতবর্ষের প্রত্যেকটা শহরের একটা নিজস্বতা রয়েছে । যা বিশেষত সেই শহরটাকে অনন্য করে তোলে । তবে বাংলার তথা আপামর বাঙালির প্রাণের শহর কলকাতার নিজস্বতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে দূর্গাপুজো, আবার ইস্টবেঙ্গল -মোহনবাগান নিয়ে মিষ্টি ভেদাভেদ থেকে যানজটে ভরা ট্রাফিক ইত্যাদি বিষয়গুলো কলকাতা শহরকে ব্যাতিক্রমী করে তুলেছে।
চলুন আজ এই ব্লগের মধ্য দিয়ে কলকাতার কিছু নস্টালজিয়া সম্পর্কে জেনে নিয়ে বাঙালীয়ানাকে আরও একবার সেলিব্রেট করে নিই ।
কলকাতায় যে কোনও ক্রিকেট খেলা আইপিএল বা ওয়ান ডে ম্যাচ প্রদর্শনের একমাত্র স্থান হল ইডেন গার্ডেন। এই বিশাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডটি ১৮৬৪ সালে নির্মিত হয় । এছাড়াও এই গ্রাউন্ডটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত। নির্মাণকালে এই ক্রিকেট গ্রাউন্ডটি 'অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন' নামে পরিচিত ছিল, পরবর্তীকালে বাইবেলের 'গার্ডেন অফ ইডেন ' দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই গ্রাউন্ডটির ইডেন গার্ডেন নামকরণ করা হয়। একবার ভাবুন তো, ইডেন গার্ডেনকে বাদ দিয়ে কি কলকাতার নস্টালজিয়া পূর্ণ হতে পারে?
২. ট্রাম -
আপনি কি জানেন ক্যালকাটা ট্রামওয়ে কোম্পানি পরিচালিত কলকাতায় চলমান ইলেকট্রিক ট্রাম এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন যান হিসেবে পরিচিত। ১৯০২ সাল থেকে আজও এই ধীরগতির যানটি কলকাতা শহরের ঐতিহ্যর সাক্ষীবহ। বর্তমান যুগে আধুনিক প্রযুক্তিগত পরিবহন ব্যাবস্থার ক্রমবিকাশ হলেও কলকাতা শহর যে তার প্রাচীনত্বকে সমানভাবে আগলে রেখেছে, এই ট্রাম তারই জ্বলন্ত উদাহরণ ।
কলকাতা শহরের দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে হাওড়া ব্রিজ অন্যতম। গঙ্গানদীর উপর ঝুলন্ত এই ব্রিজটি হাওড়া এবং কলকাতা শহর দুটিকে সংযোগ করেছে। প্রায় ৭১ফিট লম্বা এই ব্রিজ নির্মাণ করা হয় ১৯৪৩ সালে। স্বাধীনতার আগে নির্মিত এই ব্রিজটি দেশি বিদেশি সমস্ত পর্যটকের কাছে বেশ জনপ্রিয় ।
কলকাতা শহরের পরিচিতিকে কেন্দ্র করে রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল । ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিবিজড়িত এই স্মৃতিসৌধটি ১৯০৬ - ১৯২১ সালে নির্মাণ করা হয়। বাগানে মোড়া সুসজ্জিত এই স্মৃতিসৌধটির স্থাপত্যকার হলেন উইলিয়াম ইমার্সন । এই স্মৃতিসৌধটির মধ্যে ব্রিটিশ, ইজিপসিয়ান, দ্রাবিড়ীয়, মুঘল ইত্যাদি শিল্পরীতি বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায় ।
বাঙালি নস্টালজিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে কলেজস্ট্রিটের কফি হাউস। একসময়ে কলকাতার বিখ্যাত অ্যালবার্ট হল ১৮৭৬ সালে কফি হাউসে রূপান্তরিত হয়। কলেজের ক্লাস শেষ করে একদল পড়ুয়াদের আড্ডার ঠেক থেকে বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ভিত্তিক আলোচনার সূচনাকে কেন্দ্র করে রয়েছে কফি হাউস। তবে যে কোনও আলোচনাই হোক না কেন, এক কাপ কফি ছাড়া সমস্ত আলোচনাই অসম্পূর্ণ। আর কফি হাউস ছাড়া কলকাতাও অসম্পূর্ণ। তাই না?
৬. দূর্গাপুজো -
কথায় আছে দুর্গাপুজো মানেই কলকাতা। ষষ্ঠী থেকে দশমী, শহর কলকাতা মেতে ওঠে আগমনী উৎসবে । কুমোরটুলির প্রতিমা নির্মাণ থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত কিংবা বিখ্যাত রাজবাড়ীর সাবেকি পুজো থেকে সার্বজনীন থিম পুজো সমস্তটাই রঙিনভাবে এই শহরের পালিত হয়।
আচ্ছা বলুন তো বিশ্বের বৃহত্তম গাছ কোথায় অবস্থিত? হ্যাঁ একদম ঠিক ধরেছেন । কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে রয়েছে বিখ্যাত গ্রেট ব্যানিয়ন ট্রি । এই গাছটি প্রায় ৩৩০ মিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত, শুধু তাই নয় এই বটগাছ টি প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন। প্রাচীন এই বটবৃক্ষটিকে কলকাতার প্রাচীনত্বের প্রতিচ্ছবির পরিচয় দিলে কিছু ভুল হবে না ।
৮.পোলো ক্লাব -
আমাদের ভারতবর্ষে পোলো খেলার তেমন চল না থাকলেও আপনি হয়তো জেনে আশ্চর্য হবেন পোলো খেলার সূচনা হয় এই কলকাতা থেকেই । ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশরা বিশ্বের প্রথম পোলো ক্লাব নির্মাণ করেন কলকাতায়। তৎকালীন সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলিতে এই খেলাটি বেশ জনপ্রিয়তা পায় । তবে ভারতবর্ষে এই খেলা কেবলমাত্র নবাব বা রাজপরিবারের মানুষদের কাছেই সমাদৃত ছিল ।
৯. হাতে টানা রিক্সা -
ভারতের প্রায় সব অঞ্চলেই রিক্সার প্রচলন রয়েছে । কিন্তু কলকাতার রিক্সা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এককথায় বলতে গেলে কলকাতার হাতে টানা রিক্সা কলকাতা শহরের ঐতিহ্যর সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে যুক্ত । এই শহরের সঙ্গে ঐকান্তিক পরিচয় ঘটাতে রিক্সা চেপে শহরটা পরিদর্শন করে নিতে পারেন ।
এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্ল্যানেটোরিয়াম হল কলকাতার বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম।এই তারামন্ডলটি ১৯৬৩ সালে নির্মাণ করা হয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এটির শুভ উদ্বোধন করেন । বাহ্যিক দর্শনে এই তারামন্ডলটি সাঁচির বৌদ্ধ স্তুপের আদলে গঠিত । বৈজ্ঞানিক রীতিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জানার জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান হল এই প্ল্যানেটোরিয়াম।
১১. রসগোল্লা -
মিষ্টিপ্রেমী বাঙালির ঐতিহ্যর এর গোপন চাবিকাঠিটা লুকিয়ে রয়েছে রসগোল্লার মধ্যে। বাঙালির একান্ত প্রেম এই রসগোল্লার নির্মাতা হলেন শ্রী নবীন চন্দ্র দাস। ছানার তৈরি সাদা ধবধবে রসে ভরা রসগোল্লা ছাড়া ভোজনবিলাসী বাঙালি প্রায় অসহায় । আর রসগোল্লা ছাড়া কলকাতা শহরও বেমানান ।
তবে কলকাতাকে কেন্দ্র যতই যানজট, গোলমাল, মন কষাকষি থাক না কেন, বাঙালি নিজের সংস্কৃতি এবং এই শহরকে ঘিরে একটা অমোঘ টান বা ভালোবাসা যাই বলুন না কেন সেটা কে উপেক্ষা করতে পারেনা ।
আর তাই পরিশেষে সব বাঙালিই কামনা করে 'যাক ভেসে যাক দুধে ভাতে থাক, কলকাতা কলকাতাতেই' । আমার শহর, প্রাণের শহর কলকাতার গৌরব দীর্ঘজীবী হোক ।