ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে রয়েছে অনেক ফোর্ট, মিনার,স্মৃতিসৌধ। আর এই সমস্ত কিছুর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে চেনা-অচেনা নানান ইতিহাস । মৌর্য যুগ থেকে ব্রিটিশ শাসন কাল পর্যন্ত সময়ে ভারতবর্ষের নির্মিত স্থাপত্যগুলির মধ্য দিয়ে সেই সময়ের শাসন ব্যবস্থা থেকে রীতিনীতি কিংবা আদব কায়দা এমনকি শিল্পশৈলী সম্পর্কে সূক্ষ্ম জ্ঞান আহরণ করা যায়। আর সেই ইতিহাসগুলির প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার পর ভারতবাসী হিসেবে সত্যিই গর্ব হয় ।
হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন …আজকে এই ব্লগ এর বিষয়টা ভারতের সেই অতীতকে কেন্দ্র করেই । চলুন না আজ আরও একবার আমরা সেই অতীতকে ফিরে দেখি ।
হায়দ্রাবাদ
ভারতের প্রাচীন নগরীগুলির মধ্যে হায়দ্রাবাদ হলো অন্যতম । ১৫৯১ সালে দাক্ষিণাত্যের কুতুব শাহী সাম্রাজ্যের সম্রাট মুহাম্মদ কুলী কুতব শাহ এই শহরটি নির্মাণ করেন। তেলেঙ্গানা রাজ্যের এই পুরাতন শহরটি একটা সময় বিশালাকার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল এবং কুতুব শাহী সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল। তবে এই প্রাচীন শহরের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে এই শহরের প্রাচীনত্ব এবং চারমিনার, তা কখনওই অস্বীকার করা যায় না।
চারমিনারের ইতিবৃত্ত
১৫৯১ সালে কুতুব শাহী সাম্রাজ্যের পঞ্চম শাসক মুহাম্মদ কুলী কুতুব শাহ যখন রাজ্যের রাজধানী গোলকোণ্ডা থেকে হায়দ্রাবাদে পরিবর্তন করেন, মূলত সেই সময়েই চারমিনার নির্মাণ করা হয় । তবে এই চারমিনার কেন নির্মাণ করা হয় সেই সম্পর্কে অনেকগুলি তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
১. ফরাসী পর্যটক জেন দে থেভেনট ১৭ শতকে তাঁর একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ইসলামীয় সাম্রাজ্যের দুই সহস্র বর্ষপূর্তি উদযাপনের জন্য এই চারমিনার নির্মাণ করা হয়।
২.চারমিনার নির্মাণ প্রসঙ্গে আরেকটি সূত্র হলো - ভারতের সঙ্গে বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্পর্কে লেনদেনের প্রধান বন্দর ছিল মচ্ছলিপট্টনম । আর সেই বাণিজ্য ব্যবস্থাপনাকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করার জন্য হায়দ্রাবাদের চারমিনার নির্মিত হয় ।
৩. লৌকিক কাহিনি অনুসারে এবং 'Days of the beloved' গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় সম্রাট কুতুব শাহ প্রথম যে স্থানে রানী ভাগমতীর দর্শন পেয়েছিলেন, ঠিক সেই স্থানেই চারমিনার স্থাপন করেন । তবে গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী ১৫৮৯ সালে এই স্মৃতিসৌধ তথা মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৫৯১-১৫৯২ এর এই নির্মাণকার্য সম্পন্ন হয়। রানীর ইসলাম ধর্মগ্রহণ করার পরই কুতুব শাহ এই শহরটি হায়দ্রাবাদ নামে অভিসিক্ত করেন।
৪. বহুল জনমত অনুসারে - একদা এই রাজ্যে কলেরা মহামারীর প্রকোপ লক্ষ করা যায় এবং সেই সময় এই মারণ রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য শহরের কেন্দ্রে চারমিনার নির্মাণ করা হয়।
চারমিনারের পরিকাঠামো
চারটি স্তম্ভ দ্বারা গঠিত এই স্মৃতিসৌধের সম্মুখে রয়েছে বিশাল তোরণদ্বার ।এই দ্বারের উচ্চতা প্রায় ২০ মিটার এবং স্তম্ভগুলির উচ্চতা প্রায় ৫৬মিটার। চারমিনারের স্তম্ভ গুলির সাথে তাজ মহলের স্তম্ভগুলির হুবহু সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। এখানে স্তম্ভ গুলির মধ্যভাগে রয়েছে দ্বিস্তরীয় অলিন্দ। বিশেষত গ্রানাইট, চুনাপাথর, মর্টার সহযোগে সম্পূর্ণ স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে।
চারমিনারের অন্দরসজ্জা
চারমিনারের অন্দরসজ্জার ক্ষেত্রে দামী মার্বেল পাথরের সমাহার চোখে পড়ে। নীচতলা থেকে উপরের যাওয়ার জন্য মোট ১৪৯টি সিঁড়ি রয়েছে।
এই স্মৃতিসৌধের এক্কেবারে অন্তিম তলার পশ্চিমপ্রান্তে রয়েছে একটি মসজিদ, যেখানে প্রতি জুম্মাবারে ভগবানকে আরাধনা এবং যে কোনো ইসলামীয় ধর্মানুষ্ঠান সাড়ম্বরে পালন করা হয়।
চারমিনারের স্থাপত্যশৈলী
প্রায় ৪০০ বছরের এই প্রাচীন স্মৃতিসৌধটিতে ইন্দো - ইসলামীয় স্থাপত্যর একটি অসাধারণ নিদর্শন । তৎকালীন সময়ে ইরানের স্থাপত্যকার মীর মোমিন আসতারাওয়াদি এই স্মৃতিসৌধটির নকশা তৈরী করেন।
হায়দ্রাবাদের চারমিনারের এই স্থাপত্যর সাথে হিন্দু শিল্পরীতির একটা নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যায় এই স্মৃতিসৌধটি শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়াকে স্মরণে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে।
চারমিনারের রহস্যময় টানেল
লোকশ্রুতি অনুযায়ী জানা যায় এই চারমিনারের ভূগর্ভে একটি টানেল আছে যা গোলকোন্ডা ফোর্ট এর সঙ্গে সংযুক্ত। মনে করা হয়, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নিজেদের রক্ষার স্বার্থেই এই টানেল নির্মাণ করা হয়।
পারিপার্শ্বিক দর্শনীয় স্থান
চারমিনার দর্শন করার পর হাতে কিছুটা সময় থাকলে মিক্কা মসজিদ, লাদ বাজার, চার কামান, নিজাম মিউজিয়াম, গুলজা হউজ, চৌমহল্লা প্যালেস পরিদর্শন করে নিতে পারেন।
প্রবেশমূল্য
ভারতীয় নাগরিকদের চারমিনার পরিদর্শনের খরচ মাত্র ৫ টাকা এবং বিদেশী পর্যটকদের প্রবেশমূল্য ১০০ টাকা।
সময়সীমা
এই স্মৃতিসৌধটি প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫.৩০ পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা আছে।
কীভাবে যাবেন -
বিমানে - কলকাতার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পৌঁছে যান রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর । বিমানবন্দর থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাত্র ২৪ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন চারমিনার ।
ট্রেনে - হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে পৌঁছে যান হায়দ্রাবাদ স্টেশন। স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাত্র ১৫মিনিটের দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান চারমিনার।
প্রাচীন ইতিহাসের স্মৃতিরোমন্থন করে ভ্রমণের পরিকল্পনাটা কতটা রোমহর্ষক হলো নিচে কমেন্ট বাক্সে লিখে জানাতে কিন্তু ভুলবেন না ।