শিল্প ও শিল্পীর ভালবাসার মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা কৃষ্ণনগর শহর, যে শুধুমাত্র মাটির পুতুল, জগদ্ধাত্রী পুজো অথবা সরভাজা-সরপুরিয়ার জন্য বিখ্যাত তা কিন্তু নয়। এই কৃষ্ণনগর শহরের বুকে এমন অনেক তথ্য লুকিয়ে আছে, যা বহু মানুষের কাছে আজও অজানা। আর এই অজানা পথের সন্ধান দিতে এবারের মুখ্য বিষয় কৃষ্ণনগরের ‘বারোদোল মেলা’, যেটি নদীয়া জেলার প্রাচীন মেলাগুলির মধ্যে অন্যতম।
বারোদোল মেলার উদ্ভব ইতিহাস :-
নদীয়া জেলা তথা কৃষ্ণনগরের অন্যতম বিখ্যাত একটি মেলা হল এই বারোদোলের মেলা। অনুমান করা হয়, ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এই মেলার প্রবর্তন করেন। তবে এই মেলার প্রবর্তন সময় সম্পর্কে সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া আজও যায় নি।
কথিত আছে, নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দুজন মহিষী ছিলেন। রুপবতী, লাবণ্যময়ী, গুণবতী দ্বিতীয় মহিষীকে নিয়ে রাজা বীরনগরে উলায় রাঘব রায়ের নির্মিত জলবাটিকায় ক'দিন থাকবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু রাজকার্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ার দরুন তিনি রানিমাকে নিয়ে এই স্থানে যেতে অসমর্থ হন। ফলে রাজমহিষীর এই স্থানের মেলা দেখার ইচ্ছা মনের মধ্যে থেকে যায়। তাই রানিমার মনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে এই মেলার প্রবর্তন করেন, যাতে রানিমা এবং অন্যান্য অন্তঃপুরবাসিনীরাও রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকেই এই মেলা দেখতে পারেন।
মেলার নামকরণ:-
এই মেলার নামকরণ নিয়ে বেশ কিছু মতান্তর রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন দোল পূর্ণিমার ১২ দিন পরে মেলা উদযাপিত হয়, তাই তার নাম বারোদোলের মেলা। আবার কারও কারও মতে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজবাড়ির কুল বিগ্রহ বড়নারায়ন ব্যতীত আরও ১২টি কৃষ্ণ বিগ্রহ বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে এসে সমারোহ সহকারে তিনদিন রাজবাড়ির নাটমন্দিরে পুজো করাতেন বলে এই মেলার নাম বারোদোলের মেলা। বিরহী, শান্তিপুর, সুত্রাগড়, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, তেহট্ট, বহিরগাছি প্রভৃতি বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ১২টি বিগ্রহের নাম-
• বলরাম
• শ্রীগোপীমোহন
• লক্ষীকান্ত
• ছোট নারায়ণ
• ব্রহ্মণ্যদেব
• গড়ের গোপাল
• অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ
• নদিয়া গোপাল
• তেহট্টর কৃষ্ণরায়
• কৃষ্ণচন্দ্র
• শ্রীগোবিন্দদেব
• মদনগোপাল
এই ১২টি জায়গার কৃষ্ণ বিগ্রহ রাজবাড়িতে এনে মহাসমারোহে সুসজ্জিত শঙ্খ অলংকৃত ঠাকুরদালানে চাঁদনী বা নাটমন্দিরে বিগ্রহগুলিকে রেখে প্রথম তিন দিন পূজার্চনা করা হয়। বিগ্রহগুলিকে পৃথক পৃথক মঞ্চে স্থানান্তর করে মেলার প্রথম ৩ দিন তিন রকম ভাবে সাজানো হয়, যথা- রাজবেশ, ফুলবেশ এবং রাখালবেশ। এই সময় সমস্ত কৃষ্ণনগরবাসী এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত দর্শনার্থীদের জন্য রাজবাড়ির দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এছাড়াও ২০১৯ সালে প্রথমবার প্রায় ৩০০ বছর পর রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকে রাজবাড়ির নাটমন্দিরের অধিষ্ঠিত হয়েছেন মা অন্নপূর্ণার চরণ, শিবলিঙ্গ, জয়লক্ষ্মী, বিজয়লক্ষ্মী, যা দর্শন করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে এসেছিলেন এই মেলা প্রাঙ্গণে।
মেলার আনুষ্ঠানিক সময়পর্ব :-
আনুমানিক ২৫৭ বছরের পুরনো এই মেলা প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার পর চৈত্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রায় এক মাস ধরে এই মেলা চলে। তবে ঠাকুর থাকে প্রথম তিন দিন। আর এই তিনদিনই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির অন্দরমহলের নাটমন্দিরে সবাই ঠাকুর দর্শনের জন্য প্রবেশ করতে পারেন।
মেলার প্রধান আকর্ষণীয় বিষয় বিষয়বস্তু:-
বারোদোল মেলার বিশেষ আকর্ষণ হল সার্কাস এবং মরন কূপ, যা সচরাচর কোন মেলাতে দেখতে পাওয়া যায় না। বৃহত্তর এই মেলাতে গেলে আপনি তিনটি অংশ খুঁজে পাবেন। প্রথম ও তৃতীয় অংশে বিভিন্ন রকম বাহারি সামগ্রীর দোকান, মুখরোচক খাবারের দোকান আর মেলা প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে থাকে বিভিন্ন দোলনা এবং মনোরঞ্জণদায়ক খেলাধুলার সমাহার। এই মেলায় শুধু কৃষ্ণনগর বা আশেপাশের তৈরি জনপ্রিয় দ্রব্য সামগ্রী বিক্রি হয় না, বরং দূরদূরান্ত থেকেও অনেক মানুষ এসে এই মেলায় তাদের বিখ্যাত জিনিসের দোকান দিয়ে থাকেন। আচার থেকে আলমারি; কৃষ্ণনগরের বারোদোল মেলা প্রাঙ্গণে সবকিছুই বর্তমান।
মেলায় পৌঁছানোর পথনির্দেশ:-
• কৃষ্ণনগর রেল স্টেশন থেকে টোটো করে আপনি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মাঠে এসে পৌঁছলে এই মেলা দেখতে পাবেন।
• অথবা, কৃষ্ণনগর বাসট্যান্ড থেকেও আপনি টোটো করে এই বারোদোল মেলায় পৌঁছতে পারবেন।
সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তাই ২০২০ সালে পারিপার্শ্বিক দিক বিচার করে কমিটির তরফ থেকে জনস্বার্থে এই মেলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই বছর হয়তো আবার পুরনো ছন্দে নিজস্ব স্বমহিমায় ফিরতে চলেছে কৃষ্ণনগরবাসীর অত্যন্ত প্রিয় বারোদোল মেলা।