
ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। হস্তশিল্প কলা থেকে নৃত্য এমনকি চিত্রকলার ক্ষেত্রে ও লোকসংস্কৃতির প্রসার লক্ষ করা যায় ; যা একই সঙ্গে ভারতের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। এই ব্লগে রয়েছে তেমনই এক লোকসংস্কৃতির কাহিনি যা সমগ্র ভারতের সংস্কৃতিকে গৌরবান্বিত করেছে ।এককথায় বলতে গেলে এই চিত্রশিল্পগুলি ভারতের সংস্কৃতির এক একটা রত্ন, যা আধুনিক সংস্কৃতির ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে বর্তমানে এই শিল্পগুলোই আবারও নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হচ্ছে।
ভারতের লোকসংস্কৃতির ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে জানা যায় আমাদের দেশে অনেকগুলি চিত্রশিল্প বর্তমান রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল ওয়ার্লি চিত্রকলা। ঐতিহাসিকদের মতে, এই চিত্রশিল্পটি সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পকলা হিসেবে পরিচিত ।
ওয়ার্লি শিল্পকলার উদ্ভবের ইতিহাস -

ওয়ার্লি শিল্পের উৎপত্তি সময়কাল হিসেবে ১০ম শতককে বেছে নেওয়া হয় । এক্ষেত্রে ঐতিহাসিকরা কিছু প্রাচীনকালের নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন । আবার কিছু ঐতিহাসিক এই শিল্পের উৎপত্তির সময়কাল হিসেবে প্রাগৈতিহাসিক যুগকেও বেছে নেন । তবে দুর্ভাগ্যবশত ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই শিল্পকলাটি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গিয়েছে ।
ওয়ার্লি শিল্পকলা মূলত ওয়ার্লি আদিবাসী সম্প্রদায়ের হাত ধরেই ভারতে এসেছে। ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সহ্যদ্রি রেঞ্জের উত্তরবর্তী অঞ্চল অর্থাৎ দাহনু, তালাশারি, জওহর, পালঘাট, মোখাণ্ডা এবং বিক্রমগড় অঞ্চল জুড়ে এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবস্থান । তবে আদিবাসী শিল্পের উৎপত্তিস্থল কিন্তু মহারাষ্ট্র ।
ওয়ার্লি চিত্রশিল্পের বিশেষত্ব -

ওয়ার্লি সম্প্রদায়ের মানুষরা মূলত চিত্রশিল্পের সাহায্যে নিজেদের গতানুগতিক জীবনধারার বহিঃপ্রকাশ করেন । তাদের জীবনকাহিনিগুলি কখনও তাদের ভিটে কিংবা ব্যবহার্য জিনিসপত্রগুলিকে জ্যামিতিক আদলে ফুটিয়ে তোলেন । অনেক সময় এই শিল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে আসে লোককথা, পৌরাণিক কাহিনি এবং আর্থ সামাজিক পরিকাঠামো। প্রত্যেক থিমের মধ্যে একটা চেনা ছন্দ পরিলক্ষণ করা যায়। এই শিল্পটি মূলত আদিবাসী মহিলাদের দ্বারাই সৃষ্ট।
শিল্পনির্মাণে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র -
ওয়ার্লি সম্প্রদায়ের কাছে এই চিত্রশিল্প অনেকটা অব্যক্ত ভাষার মতো । চিরাচরিত প্রথা অনুসারে এই মানুষগুলো তাদের সুখী গৃহকন্যার দেওয়ালগুলিতে অঙ্কন করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন । যেহেতু এই ঘর গুলি মাটি এবং ইট সহযোগে নির্মিত তাই প্রথমে দেওয়ালে লাল রঙ করে নেন । তারপর চালের গুঁড়ো, জল এবং আঠা সহযোগে একটি মিশ্রণ বানিয়ে রং নির্মাণ করেন । অন্যদিকে বাঁশ গাছের কাঠকে তুলির মতো তৈরি করে নিয়ে ছবি অঙ্কন করে থাকেন । প্রধানত কোনও উৎসবে অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই অঙ্কন করা হয় ।
বর্তমান সময়ে এই চিত্রশিল্পের ব্যবহার -
একটা সময় পর্যন্ত এই চিত্রশিল্পটি স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণে ওয়ার্লি সম্প্রদায়কে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে ২০১৬ সালে কিছু বিখ্যাত জাপানি শিল্পী ওয়ার্লি চিত্রকলাকে যোগ্য মর্যাদা প্রদান করার কারণে থানের গাঞ্জাগ গ্রামকে দত্তক নেন; কারণ মহারাষ্ট্রর একমাত্র এই গ্রামটিতেই সবচেয়ে বেশী সংখ্যক ওয়ার্লি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন । আর তাই এই জনগোষ্ঠী তথা চিত্রশিল্পকে রক্ষার জন্যই এই গ্রামটিকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।এছাড়াও বর্তমানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন শাড়ি, গৃহের অন্দর সজ্জার উপকরণের মধ্যে এই শিল্পের স্পর্শ লক্ষ করা যায় ।
ভারতের এই প্রাচীন লোকসংস্কৃতিগুলি চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে সেগুলি সযত্নে রক্ষা করার দায়িত্বটা আমাদেরই । তাই না? আধুনিক যুগে আমরা জীবনের অনেকটা সময় সোশ্যাল মিডিয়াকে দিয়ে থাকি । তাই সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যেই যদি এই বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রচার করি তাহলে তাহলে এই শিল্প তথা দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোকে সাহায্য করতে পারি । এছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা জিনিসপত্রগুলো কিনে ও তাদের সাহায্য করা যেতে পারে ।
সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাওয়ার আগে আমরা সকলে একজোট হয়ে এই ওয়ার্লি চিত্রকলাকে কি রক্ষা করতে পারি না?