পশ্চিম সিকিমের এক প্রান্তে, গ্যাংটক থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত রিনছেনপং আদ্যোপান্ত একটি ছিমছাম পাহাড়ি গ্রাম। কিন্তু বিগত কিছু দশকে রিনছেনপং হয়ে উঠেছে বাঙালি পর্যটকদের কাছে এক অফবিট হিডেন ট্রেসার। তার মুখ্য কারণ প্রধানত দুটি, প্রথমত পেলিঙের মতো একটি বড় শহরের সান্নিধ্য। ফলে পর্যটকরা সহজেই শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং থেকে এখানে পৌঁছতে পারেন। দ্বিতীয়ত হল সমগ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের অসাধারণ ভিউ। কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের ঠিক বিপরীত দিকেই অবস্থিত হওয়ার ফলে আকাশ পরিষ্কার থাকলে সারাদিন ধরে ঘরে বসেই পাওয়া যায় এক অতুলনীয় মাউন্টেন ভিউ, যা হয়তো নিকটবর্তী সবকটি হিল স্টেশনের ভিউ পয়েন্টগুলোকে টেক্কা দিয়ে যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫৫৭৬ ফিট উপরে অবস্থিত রিনছেনপং পাহাড়ের কোলে বেড়ে ওঠা এমন এক স্বপ্নের দেশ যা আজও অত্যধিক পর্যটকদের ভিড়ে নুয়ে পড়েনি। পশ্চিম সিকিমে ঘোরার সময় হি, বার্মিওক, দেনতাম বা উত্তারে-কে পিছনে ফেলে স্বচ্ছন্দে কিছু দিন কাটিয়ে যেতে পারেন এই রিনছেনপং গ্রামটিতে...
রিনছেনপং : এক প্রাকৃতিক বিস্ময়
রিনছেনপং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে শুরু থেকেই প্রথমের সারিতে। কুয়াশা ঘেরা ঘন সবুজ জঙ্গল দিয়ে ঢাকা থাকে দূরের পর্বতমালা। চারিদিকে ময়না, টেলরবার্ড, বুলবুল, আর নাটক্র্যাকার পাখির কলরব - বার্ড ওয়াচারদের জন্যে সত্যিকারের এক প্যারাডাইস। অর্গানিক ফার্মিংয়ের দিক থেকেও রিনছেনপং এগিয়ে সবার থেকে - গ্রামবাসীদের নিজস্ব ফর্মে দেখতে পাবেন কিউই, কমলালেবু, মুসুম্বি বা চেরীর চাষ। শুধু ফল নয় - এই অঞ্চলে পাবেন এলাচ, হলুদ, আদা থেকে শুরু করে নানান কিছুর সন্ধান। স্থানীয় হোম স্টে যে থাকলে পাবেন এগুলি খেয়ে দেখার সুযোগও। ইচ্ছে হলে কিনেও নিয়ে আসতে পারেন নিজেদের জন্যে। আর পাবেন চারিদিকে ঘন রোডোডেনড্রোনের জঙ্গল, মাঝে মাঝে নাম না জানা কিছু পাহাড়ি অর্কিডের হাতছানি। প্রকৃতির কোলে ফিরে যেতে চাইলে, রিনছেনপং যেন সদাপ্রস্তুত আপনার স্বপ্ন সত্যি করার জন্যে।
রিনছেনপং আর তার দুই মনেস্ট্রি
ছোট্ট একটি জায়গা হলেও, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে রিনছেনপং বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আছে এক নয়, দুটি মনেস্ট্রি। অষ্টাদশ শতকে তৈরি হয়েছিল রিশুম গুম্ফা, যার সামনে থেকে সমগ্র উপত্যকার অসাধারন ভিউ পাওয়া যায়। সূর্যোদয়ের সময়ে এখানে আসতে পারলে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রথম সকালের দুধে আলতা রং স্বচক্ষে দেখতে পারবেন। এই মনেস্ট্রির ঠিক পিছনেই রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির উদ্দ্যেশে তৈরি একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র। রিশুম মোনাস্ট্রির পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটি ছোট্ট ট্রেক করলে পেয়ে যাবেন আরও উপরে অবস্থিত দ্বিতীয় গুম্ফাটির সন্ধান। মনে করা হয় এই মনেস্ট্রিটি তৈরি হয়েছিল ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে। ভিতরে রয়েছে অতিবুদ্ধ রূপে ভগবান বুদ্ধের অপরূপ এক মূর্তি
বিষপোখরি
রিনছেনপং মনেস্ট্রি থেকে একটু হেঁটে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবেন একটি পুরনো ব্রিটিশ আমলের বাংলোর। বাংলোর সামনে অল্প নীচে দেখতে পাবেন একটি প্রায় শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়। জলাশয়টি ছিল ব্রিটিশ শাসক এবং তাঁদের সৈন্যদের জলসঞ্চয়ের প্রধান স্থল। কথিত আছে ১৮৬০ সাল নাগাদ যখন ব্রিটিশ সৈন্যদল এই অঞ্চলে অগ্রসর হতে শুরু করে, তখন স্থানীয় লেপচা জনগোষ্ঠীর মানুষজন এই লেকের জলে বিষ মিশিয়ে দেন। বহু ব্রিটিশ সৈনিকের প্রাণনাশের পরে তারা বাধ্য হয় পিছু হটতে। বিষাক্ত জল না থাকলেও বিষপোখরি বা পয়জন লেকটি আজও তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। আর পরিত্যক্ত ব্রিটিশ বাংলোটিকে বর্তমানে পরিণত করা হয়েছে একটি গেস্ট হাউসে।
চলুন পশ্চিম সিকিমে ডে ট্রিপে
রিনছেনপং থেকে কিন্তু স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করে সহজেই ঘুরে আসতে পারেন পশ্চিম সিকিমের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট থেকে। এখান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে ছায়াতাল লেক, যেখান থেকে আপনি পাবেন চারিদিকের পর্বতমালার অসাধারণ ভিউ। লেকের কাছাকাছি রয়েছে সিরিজুঙ্গা মন্দির, যা স্থানীয় লিম্বু জনগোষ্ঠীর মানুষদের এক অন্যতম পীঠস্থান। ঘুরে আসতে পারেন সিংশোর ব্রিজ থেকে, যা এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম ব্রিজ। অল্প এগিয়ে গেলে পাবেন উত্তারে গ্রাম, যেখানে রয়েছে ট্রাউট মাছের ফার্ম। ভোজনরসিক হলে ঘুরে দেখতে পারেন দেনতামের চিজ ফ্যাক্টরি, এনারা সর্বভারতীয় সংস্থা আমূলকে চিজ সরবরাহ করে থাকেন। রিনছেনপং থেকে ২০ কিলোমিটার দুরত্বে লেগশিপ বাজারের কাছে আছে উষ্ণ প্রস্রবন, অফবিট ট্যুরিস্টদের জন্যে বিশ্রামের আদর্শ জায়গা।