ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর প্রকৃতির আশীর্বাদ অপরিসীম।দক্ষিণের সোনালি সমুদ্র সৈকত থেকে উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা এবং পশ্চিমে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য, ভারতের সমস্ত প্রায় প্রতিটি কোণেই প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
ভারতীয় মূল ভূখণ্ডে প্রচুর জনপ্রিয় দ্বীপ থাকলেও এমন কিছু দ্বীপ এখনও আছে যা লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে (আন্দামান নিকোবর ব্যাতিত অবশ্যই এক্ষেত্রে)। সমুদ্র সৈকতের কোলে গোপনে, নিভৃতে থাকা এই দ্বীপগুলিই হয়ে উঠতে পারে উৎসাহী পর্যটকদের জন্য একেবারে উপযুক্ত গন্তব্যস্থল।
১। সেন্ট মেরী আইল্যান্ড, কর্ণাটক
আরব সাগরের তীরে এই দ্বীপটিতে আপনি ছোটখাটো এক টুকরো আইসল্যান্ডের ছোঁয়া পেয়ে যাবেন। মাল্পে উপত্যকা থেকে খুব কাছেই অবস্থিত এই সেন্ট মেরী আইল্যান্ড। বেসাল্ট পাথর বা শিলা স্তরে স্তরে স্তম্ভাকারে জমে জমে তৈরি করেছে এইধরনের ভূ-প্রকৃতি। কার্যত যা এখানকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ, বৈজ্ঞানিক গবেষণাতে জানা গেছে আগ্নেয়গিরির সাবএরিয়াল এবং সাব ভোলক্যানিক কারণে এই দ্বীপটির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সেই সময় মাদাগাস্কার ভারতীয় ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল। প্রায় ৮৮ লক্ষ বছর আগে মাদাগাস্কারের বিচ্যুতি ঘটেছিল। মূলত এই প্রাকৃতিক ঘটনার কারণেই...
এই দ্বীপটির যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন ভাস্কো দা গামা এই দ্বীপেই সর্বপ্রথম এসেছিলেন এবং তাঁর মায়ের নামে এই দ্বীপের নামকরণ করা হয়। সেন্ট মেরী দ্বীপ ভারতের ২৬ টি ভৌগোলিক মনুমেন্টের মধ্যে একটি অন্যতম।
কীভাবে যাবেন : মাল্পে উপত্যকা থেকে ফেরি নিয়ে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন এই দ্বীপটিতে। মাল্পে উদুপি থেকে ৬০ কিমি দূরে অবস্থিত এই দ্বীপ।
২। কাব্বায়ি, কেরালা
উত্তর কেরালার সবচেয়ে বৃহদাকার ব্যাকওয়াটার কাব্বায়ি, কায়ালে অবস্থিত ছোট্ট একটি দ্বীপ হল কাব্বাই। এই দ্বীপটির ছোট্ট পরিসীমার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বেশ কিছু অজানা ঐতিহাসিক কথা। অনেক বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক যেমন মার্কো পোলো, ইবন বতুতা, এমনকি আব্দুল ফিদাও নিজেদের ভ্রমণ রচনাবলীতে কাব্বায়ির উল্লেখ করেছেন। এই জনবিরল দ্বীপটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্যও বিশেষ গুরুত্ব পায়। জমিদারদের দ্বারা চালিত এই দ্বীপটি বন্দর হিসেবে ব্যবহার হত এবং এখানে কোর্টের মাজিস্ট্রেটের প্রধান আবাসস্থল ছিল।
৩৭ বর্গকিমির এই জলাভূমি উত্তর কেরালার সর্ববৃহৎ বাস্তুতন্ত্র হিসেবে বিখ্যাত। ভালিয়াপারাম্বা দ্বীপও একই ব্যাকওয়াটারে, কাব্বায়ি দ্বীপ থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে অবস্থিত।
কীভাবে যাবেন : মেইন ল্যান্ড থেকে হয় ফেরির মাধ্যমে না হলে মাভিলা কাদাপ্পুরাম ব্রিজ পেরিয়ে আপনাকে পৌঁছতে হবে এই দ্বীপে। সবথেকে কাছের রেলওয়ে স্টেশন হল কোজিকোটে- মাঙ্গালোর চেরাভাথুর।
৩। ডিভার আইল্যান্ড, গোয়া
ডিভার আইল্যান্ড গোয়ার মান্দভি নদীর তীরে অবস্থিত। এই বিশাল দ্বীপটি ৪টি গ্রামে বিভক্ত ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। চারপাশের ভৌগোলিক এলাকা থেকে বিছিন্ন হওয়ার ফলে নির্জন এই দ্বীপটিতে সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে গাছে। জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে ডিভারে প্রথমে ওল্ড গোয়ার বাসিন্দারা বসবাস করত। প্লেগ মহামারী পুরো গোয়াতে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ওল্ড গোয়া থেকে মানুষেরা এসে এখানে বসবাস করতে শুরু করে।
প্রতি বছর ডিভার মূলত ৩ টি উৎসব পালন করার জন্য আলোর সাজে সেজে ওঠে। এই ৩টি উৎসব এর মধ্যে ২টি হল 'বন্দেরাম' ও 'পতেকার'। বন্দেরাম উৎসবে অগাস্ট মাসের প্রতি চতুর্থ শনিবার কার্নিভাল পালন করা হয়ে থাকে। পতেকার উৎসব অনেকটা হ্যালোউইনের মতো। লেন্টের ৩দিন আগে থেকে এর উদযাপন শুরু হয় এবং স্থানীয় মানুষেরা হাতে বানানো মুখোশ ও পোশাক পরে এই উৎসব পালন করে থাকেন।
কীভাবে যাবেন : রিবান্দার এবং ওল্ড গোয়া থেকে ফেরি নিয়ে জেতে হবে এই দ্বীপে। দ্বীপটি পঞ্জিম থেকে ১০ কিমি ওপরে অবস্থিত।
৪। শ্রীরাঙ্গাপাটানাম, কর্ণাটক
শ্রীারাঙ্গাপাটানামে বৈষ্ণব ধর্মের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির অবস্থিত এবং খুব সম্ভবত আপনি এই জায়গাটির কথা জেনে থাকবেন। কাবেরী নদীর তীরে অবস্থিত এই দ্বীপটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিশাল ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আছে। টিপু সুলতানের রাজত্বকালের আগে স্থানটি গৌরবময় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। কিন্তু গঙ্গা সাম্রাজ্যের পল্লব বংশ রাঙ্গানাথস্বামী মন্দিরের স্থাপনকর্ম প্রথম শুরু করে। টিপু সুলতানের সাম্রাজ্যকালে শ্রীরাঙ্গাপাটানাম বেশ কিছুতকাল কর্ণাটকের রাজধানী হিসেবেই সুপরিচিত ছিল।
শ্রীরাঙ্গাপাটানামে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্য রয়েছে। কিন্তু টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর ওনার স্মৃতিতে যে পাথরের স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে তার বিশেষ উল্লেখযোগ্যতা লক্ষ করা যায় এই প্রসঙ্গে।
কীভাবে যাবেন : মাইসোর থেকে ট্যাক্সি/বাস/ট্রেন নিয়ে আপনি চলে যেতে পারেন এখানে অথবা বেঙ্গালুরু থেকে আপনি ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে যেতে পারেন ১৫০ কিমি দূরে অবস্থিত এই দ্বীপটিতে।
৫। সাও জাকিন্ত, গোয়া
১৯৭২ সালের এই দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দারা ঠিক করেন তারা তাদের এই দ্বীপটিতে কোনওভাবেই তারা হোটেল তৈরির জন্য অনুমোদন দেবেন না। আজ থেকে বছর চল্লিশ আগে নেওয়া এই সিদ্ধান্তই আজও এই দ্বীপটির প্রাকৃতিক নির্মলতাকে অটুট রেখেছে। কিছু পুরনো বাড়ি ছাড়া এখানে মাত্র দুটি স্থাপত্য আছে, একটি হল সেন্ট হ্যাইয়াসিন্থি ক্যাথিড্রাল এবং একটি পরিত্যক্ত লাইটহাউস।
সিলভার গেট নামক একটি ছোট্ট ব্রিজ এই দ্বীপটিকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে। এখানে একটি আন্ডারওয়াটার টানেল আছে যেখানে আপনি সিরিদাও বীচ হয়ে পৌঁছে যেতে পারেন।
কীভাবে যাবেন : ডাবলিম এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে আপনি এখানে থামতে পারেন। বগমালো থেকে এই দ্বীপটি প্রায় ৫ কিমি দূরে অবস্থিত।
৬। হোপ আইল্যান্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ
প্রায় ২০০ বছর আগে গোদাবরী নদীর উপনদীর তট থেকে বালির অপসারণের ফলে এই দ্বীপটি সৃষ্টি হয়। ব্যাঙ্গাচির আকৃতির ছোট্ট এই দ্বীপটি কাকিনাড়া বন্দরকে ও গোটা শহরকে প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা সাইক্লোন থেকে রক্ষা করে। একমাত্র এই হোপ আইল্যান্ডের জন্যই কাকিনাড়া পূর্ব ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ বন্দর হিসেবে পরিচিত।
বর্তমানে হোপ আইল্যান্ডে কয়েকটি মাত্র সরকারি আবাসন ও মৎস্যজীবীদের বাসস্থান রয়েছে। এই দ্বীপের একদম উত্তর প্রান্তের অংশটি গোদাবরী পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত যার অপর প্রান্তে কাকিনাড়া বন্দর ও শহর অবস্থিত।
কীভাবে যাবেন : কাকিনাড়া বন্দর থেকে ফেরি নিয়ে পৌঁছে যেতে পারবেন এই দ্বীপে এবং কাকিনাড়া শহর হল নিকটতম শহর।
মহাভারতে যে প্রাচীন শহর দ্বারকার উল্লেখ আছে অনেকে বেট দ্বারকাকে সেই মহাভারতের শহর বলে বিশ্বাস করে থাকেন। আপনার যদি পৌরাণিক কাহিনিতে বিশ্বাস নাও থাকে তাহলেও এই স্থানের বিশেষ ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্যতা রয়েছে কারণ এই দ্বীপটিই সেই সময়কার ভারত ও রোমের মধ্যে একটি প্রধান বাণিজ্যপথ হিসেবে ব্যবহার করা হত। এমনকি এই দ্বীপটির অস্তিত্ব হরপ্পা একই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে পাওয়া যায়।
অনেক কটি ধর্মীয় স্থান ছাড়াও, এই দ্বীপটির চারিদিকে বেশ কিছু অপূর্ব সুন্দর সমুদ্র সৈকত আছে। এই দ্বীপটির সবচেয়ে দক্ষিণের অংশটিকে ডানি পয়েন্ট বলে পরিচিত যেটির তিন দিকই সমুদ্র দিয়ে ঘেরা।
কীভাবে যাবেন : খুব সহজেই ওখা থেকে ফেরি নিয়ে এখানে পৌঁছে যেতে পারেন। ওখার নিকটতম শহর হল জামনগর।
৮। কুইব্বলে আইল্যান্ড, তামিলনাড়ু
আদ্যা নদীর নোনা জলের সংস্পর্শে যেন ধীরে ধীরে বড় হয়েছে এই চারটি ছোট্ট দ্বীপ। তাঁর মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড়ো দ্বীপটি হল কুইব্বলে আইল্যান্ড। এই অগভীর জলের দ্বীপটিতে ১৭৪৬ সালে ফরাসিদের অধিনায়কত্বে ভারতীয় বাহিনী নবাবের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধের পরবর্তীকালে শহীদদের উদ্দেশ্যে নির্মিত কবরস্থানটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
জনবহুল শহর চেন্নাই এর খুব কাছে অবস্থিত হলেও এই দ্বীপটি শহরের কোলাহল থেকে এখনও বেশ নিরিবিলি বলতে হবে।
কীভাবে যাবেন : সড়কপথে আপনি আদ্যার পৌঁছে সেখান থেকে ফেরি নিয়ে চলে যেতে পারেন কুইব্বলে আইল্যান্ড। সবথেকে নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন হল গুণ্ডি রেলওয়ে স্টেশন।