ঐতিহ্যের সমন্বয়ে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন এবং বিবরণ...

Tripoto

কৃষ্ণনগর!

ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আধুনিকতা এবং আবেগ যেখানে মেলবন্ধনের পথপ্রদর্শক। প্রাচীন নাম "রেউই" থেকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় হাত ধরে এই শহরের নামকরণ করা হয় "কৃষ্ণনগর"। বহু বছরের পুরনো এই সদর শহরটির প্রাণকেন্দ্রে থাকা অন্যতম বিষয়বস্তু হল- 'জগদ্ধাত্রী পুজো'!

পুজোর ইতিহাস

আদি সূচনাপর্বে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়-এর অনুপ্রেরণায় এই পুজোর আত্মপ্রকাশ হয়। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে এই পুজোর শুভসূচনা সম্বন্ধে আলোকপাত করা যায়। ১৭৫৪ সালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এক বিশাল অঙ্কের কর জমা করতে ব্যর্থ হলে, প্রথমে নবাব আলিবর্দি খাঁ তাঁকে কারাগারে বন্দি করেন।পরবর্তী সময়ে ১৭৬৪ সালে মীরকাশিম নিজস্ব আনুমানিক ভিত্তিতে পুণরায় তাঁকে এবং তাঁর পুত্রকে মুঙ্গেরে কারারুদ্ধ করেন।কারাগার থেকে মুক্তির পেয়ে রাজা জলপথে ফেরার সময় দেখতে পান মা রাজরাজেশ্বরী প্রায় বিসর্জনমুখী। মায়ের মুখ দেখতে না পাওয়ার বেদনায় রাজা ক্রন্দনরত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েন। আর ঠিক সেই সময় তাঁর স্বপ্নে এক অপরূপ সুন্দরী কিশোরী মূর্তি দেখা দেয়। কথিত আছে, সেই কিশোরী রাজাকে বলেন,কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে সপ্তমী অষ্টমী নবমী এই তিথির সন্ধিক্ষণে তাঁর পুজো করতে, তাহলেই মহারাজের "মা রাজরাজেশ্বরীর" পুজো দেওয়ার সাধ পূরণ হবে।আর এই ভাবেই শুরু হয় কৃষ্ণনগরের 'জগদ্ধাত্রী পুজো'।

কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত ৬টি জগদ্ধাত্রী পুজোর বিবরণ:-

১. কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সাবেকি পুজোর আয়োজন (ছবি: সংগৃহীত)

Photo of Krishnanagar, West Bengal, India by Deya Das

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই পুজোর প্রবর্তক। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী, এখানে প্রথম থেকে কুমারী রূপে মাকে পুজো করা হয়। অন্যান্য দেবীমূর্তির সাথে রাজবাড়ী দেবীমূর্তির কিছুটা আলাদা। এখানে মায়ের তাঁর একটি পা ভাঁজ করে ঘোড়ার মুখের ন্যায় সিংহের উপর বসে থাকেন এবং সিংহের মুখ থাকে সামনের দিকে। যা পুরাণের কিছু বিষয়কেই তুলে ধরে।

পথনির্দেশ:- কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে টোটো করে একাডেমি স্কুলের সামনের রাস্তা ধরে ১৫ মিনিটের পথ রাজবাড়ি।

2. চাষাপাড়া(বুড়িমা)

কৃষ্ণনগরের অন্যতম জনপ্রিয় পুজো (ছবি সংগৃহীত)

Photo of ঐতিহ্যের সমন্বয়ে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন এবং বিবরণ... by Deya Das

কৃষ্ণনগর শহরের সবথেকে ঐতিহ্যবাহী পুজো হল চাষাপাড়ার "বুড়িমা"। বলা ভাল, শুধু কৃষ্ণনাগরিকরাই নয় এই পুজোর জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে বহু প্রবাসীরা। মা-কে চাক্ষুষ দর্শনে নিজেকে ধন্য করবার আশায় তারা প্রতিবার ছুটে আসে এই শহরের বুকে। মায়ের ভুবন ভোলানো দীপ্তিময় রূপই তাঁর আভিজাত্যের প্রমাণ দেয়। কথিত আছে, এই পাড়ার একজন রিক্সা চালক মদ্যপ অবস্থায় প্রতিদিন ঠাকুরদালানের সামনে এসে বলতেন, 'এটি মা বুড়িমা আর বাকি সব দিদিমা'। এরপর থেকেই প্রচলিত ধারা মেনে মায়ের নামকরণ হয় "বুড়িমা"।মনোবাঞ্ছা, মনস্কামনা পূরণে যিনি সর্বদায় মুক্ত হস্তা আর তাঁর এই বৈভব তাঁর অলংকারের স্বীকৃত।

পথনির্দেশ:- কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে টোটো করে ২০ মিনিটের দূরত্বে পোস্ট অফিস মোড় সংলগ্ন এলাকায় লেডি কারমাইকেল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ঠিক বিপরীত রাস্তায় চাষাপাড়া বারোয়ারি অবস্থিত।

৩. কাঁঠালপোতা (ছোটমা)

ঐতিহ্যবাহী আরেক পুজোর ছবি (সংগৃহীত)

Photo of ঐতিহ্যের সমন্বয়ে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন এবং বিবরণ... by Deya Das

বুড়িমার আঙ্গিকে গড়ে ওঠা এই প্রতিমা বুড়িমার ছোট বোন হিসেবেই পরিচিত। স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা ছোটমা তাঁর রূপের ছটায় কৃষ্ণনগর শহরকে করে তুলেছে গৌরবান্বিত।

পথনির্দেশ:- কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে নেদের পাড়া মোড় হয়ে এভি স্কুল মোড় থেকে পোস্ট অফিসের দিকে এগিয়ে মাত্র ২ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত এই বারোয়ারি পুজোটি।

৪. তাঁতিপাড়া (বড়মা)

অলংকারে শোভিত দেবী মূর্তি (ছবি সংগৃহীত)

Photo of ঐতিহ্যের সমন্বয়ে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন এবং বিবরণ... by Deya Das

এই পুজোর সূচনা হয় রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোর ঠিক পরের বছর। এই বছর এই পুজোটি ২৫৬তম বছরে পদার্পণ করল। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, দেবী মা'র গায়ের রং।শিউলি ফুলের বৃন্তের রঙে দেবী মায়ের শরীর রঙিন হয়ে ওঠে। তাই এই দেবী মাকে অনেকে 'লাল ঠাকুর' বলেও আহবান করেন। প্রতিমা শরীর যে সমস্ত অলঙ্কারে ভূষিত হয়,সমস্তটাই মনস্কামনা ফল।এটি কৃষ্ণনগরের অন্যতম একটি বড় পুজো হিসাবে গণ্য করা হয়।

পথনির্দেশ:-কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকে চকের পাড়ার মধ্যে দিয়ে হাঁটা পথে মাত্র ৫ মিনিট।

৫. বালকেশ্বরী বারোয়ারি (প্রাচীন মাতা)

আভিজাত্য এবং জাঁকজমকে পরিপূর্ণ মাতৃমূর্তি (ছবি সংগৃহীত)

Photo of ঐতিহ্যের সমন্বয়ে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন এবং বিবরণ... by Deya Das

এই পুজোর শুভ আরম্ভ অদ্ভুতভাবে হয়েছিল। কিছু ছেলে একদিন ফুটবল খেলতে খেলতে তাদের মনে হঠাৎ করে বাসনা হয় জগদ্ধাত্রী পুজো করার। ঠিক এরপরে তারা প্রতিমা গঠন করে এবং বারোয়ারীর পুজো শুরু হয়। ফলস্বরূপ প্রত্যেক বছর সিংহের পায়ের নিচে একটি করে ফুটবল রাখা হয়।প্রাচীন মাতা এবছর মতানুসারে ২৪১ তম বর্ষে পা রাখলো। আলংকারিক শোভা ও সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে "প্রাচীন মাতা" অভাবনীয় হয়ে উঠেছে।

পথনির্দেশ:-কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে কৃষ্ণনগর একাডেমী স্কুলের রাস্তা দিয়ে টোটো রিক্সা মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত বালকেশ্বরী বারোয়ারী।

৬. মালোপাড়া বারোয়ারি (জলেশ্বরী মাতা)

মায়ের সাবেকি অভয় মূর্তি (ছবি : সংগৃহীত)

Photo of ঐতিহ্যের সমন্বয়ে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন এবং বিবরণ... by Deya Das

প্রধানত মালোরা হল একপ্রকার দলিত সম্প্রদায়, যাদের জীবন অতিবাহিত হয় জলের সংস্পর্শে। তাই এই পুজোর ইতিহাস বেশ অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি করে। শোনা যায়, রাজা সতীশ চন্দ্র রায়ের দ্বিতীয় রানী ভুবনেশ্বরী দেবী ১৫ টাকা দিয়ে এই মালোপাড়ার পুজোর শুভ সূচনা করেন। তারপর থেকে আজ অবধি এই পুজো সমানভাবে তার ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এখনও রাজবাড়ির সবথেকে প্রবীণতম সদস্যা এসে এই পুজোর খরচ-খরচা বারোয়ারির হাতে তুলে দিয়ে যান। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, মালোপাড়ায় দুটি বিষয় আগত দর্শনার্থীদের খুব বেশিভাবে আকর্ষণ করে।প্রথমত, জয়রামবাটির আঙ্গিকে সারদা মায়ের পুজোর রীতি মেনে জগদ্ধাত্রী মা পূজিত হন, আর দ্বিতীয়ত এই বারোয়ারিতে শিবের কারণে অর্ধনারীশ্বর রূপ কল্পনা করে মধ্যরাতে পায়ে নুপুর পরে এই অঞ্চলের পুরুষেরা নারীর সেজে অধিবাস পালন করে। মালোপাড়াবাসীর প্রতিমার মূর্তির বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় এই প্রতিমার সামনে সোনার জুলন্ত মাছ। মানসিক এর জন্য ধুনো পুজো এখানে একটি অন্যতম বিষয়।

পথনির্দেশ:-কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে ১৫ মিনিটের দূরত্বে টোটো গাড়ি করে কৃষ্ণনগর ফোয়ারার মোড় হয়ে গোয়ারী বাজার সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত এই বারোয়ারী।

ছোট-বড় মিলিয়ে কৃষ্ণনগরে প্রায় ২৫০টিরও বেশি জগদ্ধাত্রী পুজো দেখা যায়।। শুধু এটুকুই নয়, পাটাপুজো থেকে শুরু করে ঘট বিসর্জন এবং পরিশেষে প্রতিমা নিরঞ্জনের মধ্যে দিয়ে কৃষ্ণনাগরিকবৃন্দ প্রতি বছর রেখে যায় এক একটি নতুন আকর্ষনের পদচিহ্নকে।যার অপরূপ শোভা দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জমায়েত হয় এই কৃষ্ণনগরের রাজপথে। কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী মাকে রাজমাতা বলা হয় আর তার প্রমাণও হয়তো কৃষ্ণনাগরিকবৃন্দ রেখে যায় এই প্রতিমা নিরঞ্জনে। ঠিক রাজমাতার মতোই প্রতিটি জগদ্ধাত্রী মা সাঙে চেপে এগিয়ে আসে জলঙ্গীর ঘাটের দিকে।মায়ের এই মোহগ্রস্ত তেজস্বী দৃষ্টি,অবয়ব জ্যোতিরশ্মী প্রতিফলনের নজিরই হল কৃষ্ণনগরবাসির আবেগ। আর এই আবেগ দর্পণ প্রতিবিম্বের প্রতিচ্ছবি রূপে দেখা দেয়,যখন বুড়িমা তাঁর গৌরবময় আভা এবং সূর্যের কিরণের ন্যায় আলোক বিকীর্ণ করে এগিয়ে চলে জলঙ্গীর ঘাটে। আর সেই মাহেন্দ্রসন্ধিক্ষণের সংযোগ মুহূর্তে সংখ্যাতীত লোকের সমাবেশ ঘটে তখন বোঝা যায় কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো শুধু পুজো নয়, মানুষের কাছে এ-এক বৃহত্তর আবেগের জায়গা।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যাবহার করুন