শীত প্রায় শেষ হয়ে আসছে তখন কলকাতায়। শেষ বেলায় শীতের আমেজ ঘরে বসে না উপভোগ করে বেরিয়ে পড়া যাক , এই ভেবেই হঠাৎ বেরিয়ে পড়া। উদ্দেশ্য হল কলকাতার আশেপাশেই কোথাও ঘুরে আসা। এইভাবেই আচমকা চলে এলাম খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেট অঞ্চলে। যে বাজার ছাড়িয়েই রয়েছে ভূকৈলাসের রাজবাড়ি আর সেখানকার রাজাদের প্রতিষ্ঠা করা শিবমন্দির।

বাজার ছাড়িয়ে একটু এগোতেই বাঁ হাতে পড়ল রাজবাড়ি আর মন্দিরে প্রবেশ করার তোরণ। অবশ্য স্থানীয়রা জানালেন যে এই তোরণ আদি অকৃত্রিম নয়। পরে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছে। তোরণ পার করে খুবই সাধারণ দেখতে একটি গলিপথ ধরে হেঁটে সোজা যেতে হল। তবে ফ্যান্সি মার্কেট থেকে মন্দিরের কিছুটা পথ অটো যায়। যদিও রাস্তা খুব সরু বলে অটো বেশী দূর যেতে পারে না। খানিক গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে আবার এক তোরণ। সেখানে এক সময় বসত নহবত। তবে সেটির অবস্থা বেশ খারাপ। চারদিকে ঘিঞ্জি বস্তি আর প্রচুর মানুষের কোলাহল পার হয়েই দেখা গেল দুটি বিশালকায় মন্দির।
তবে শুরুতেই দেখা গেল কপাল বেশ খারাপ আমাদের। দুপুরের দিকে মন্দির বন্ধ থাকে। তাহলে কি শিব দর্শন হবে না আমাদের? দুটি মন্দির সংলগ্ন রয়েছে বাঁধানো চত্বর। সেখানে শীতের রোদ পোয়াচ্ছিলেন গুটিকয় মহিলা। তাঁরা জানালেন যে চারটে নাগাদ পুরোহিত বাবু এসে আবার মন্দির খুলবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এতক্ষণ আমরা করব কী? আমাদের মুখ দেখে বোধহয় মহিলা কিছু আন্দাজ করলেন। বললেন যে কাছেই নতুন মন্দির হয়েছে জগন্নাথের। একদম পুরীর জগন্নাথের মতো। চাইলে দেখে আসতে পারেন। অগত্যা সেই পথেই হাঁটা লাগালাম। নতুন জগন্নাথের মন্দির বেশ সুন্দর। জগ্ননাথ,বলরাম আর সুভদ্রার কাঠের মূর্তিও একদম হুবহু পুরীর মতো, যদিও আকারে একটু ছোট। তবে এখানেও পুরীর মতোই পাণ্ডাদের উৎপাত অব্যাহত। সেই মন্দির দেখে ফ্যান্সি মার্কেটের কাছে ইন্ডিয়া হোটেলে দুর্দান্ত সুস্বাদু খাবার খেয়ে আবার শিব দর্শনের চেষ্টা।
এবার মিশন সাকসেসফুল। অল্প বয়সী তরুণ পুরোহিত মন্দিরের দরজা খুলে দিতেই চক্ষু চড়কগাছ। কলকাতার এত কাছেই এত বিশাল দুটি শিবলিঙ্গ আছে এত জানাই ছিল না। পুরোহিত জানালেন যে একটি শিবের নাম হল রক্তকমলেশ্বর ও অপরটির নাম হল কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর। ১৮ ফুট উচ্চতার একেকটি করে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ রয়েছে মন্দিরে, যা কিনা একটি মাত্র পাথর কেটে তৈরি শিবলিঙ্গ হিসেবে এশিয়ার মধ্যে উচ্চতম। দুটি মন্দিরের মাঝখানে নন্দী অর্থাৎ শিবের বাহন ষাঁড়ের মূর্তি। প্রচুর সংস্কারের পর মন্দিরগাত্রের কারুকাজ আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবে উঁচু চাতালের ওপর উঠে ভিতরে প্রবেশ করলে দেওয়ালে কিছু পংখের কাজ নজরে আসে। বিশেষত রক্তকমলেশ্বর মন্দিরে। কথিত আছে সাধক রামপ্রসাদ এই মন্দির দেখতে এসে মুগ্ধ হয়ে বলেন কৈলাশ থেকে শিব স্বয়ং নেমে এসেছেন। সেই থেকে জয়নারায়ণ ঘোষালের এই ভূসম্পত্তি ভূকৈলাস নামে খ্যাত হয়। দুই মন্দিরে মধ্যে রয়েছে বিশাল একটি বাঁধানো দীঘি। যার নাম হল শিবগঙ্গা। অপর পারে জয় নারায়ণ মন্দির, তাতে রাজা জয় নারায়ণ ঘোষালের মূর্তি।

শোনা যায় বাংলায় পাল যুগ শেষ হলে যখন সেন আমল শুরু হয় তখন কনৌজ অর্থাৎ কান্য়কুব্জ থেকে একদল ব্রাহ্মণ এদেশে এলেন। তাঁদের অন্যতম ভূকৈলাশের ঘোষালরা। ঘোষাল বংশের আদি পুরুষ কন্দর্প ঘোষাল থাকতেন গোবিন্দপুর অঞ্চলে। তখনও কলকাতার পত্তন হয়নি। তাঁর ছেলে গোকুল চাঁদ ঘোষাল নুনের ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন এবং ইংরেজদের সুনজরে আসেন। ইংরেজরা তাঁকে চিটাগং বা চট্টগ্রাম (অধুনা বাংলাদেশ)-এর দেওয়ান নিযুক্ত করেন। সময়টা ১৭৬১ থেকে ১৭৬৪। একাজে অচিরেই গোকুল চাঁদ সুনাম ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। জমির কর দেওয়ার পদ্ধতিতে কিছু বদল আনেন। খিদিরপুর অঞ্চলে তিনি নিজে প্রচুর ভূসম্পত্তি কেনেন। তাঁর ভাই কৃষ্ণচন্দ্রের ছেলে জয়নারায়ণ ঘোষাল (১৭৫২ – ১৮২১) ঘোষাল বংশের আরো উন্নতি ঘটালেন। সে সময় তাঁদের বসবাস ছিল ফোর্ট উইলিয়াম অঞ্চলে। তখন (১৭৫৮ সাল) সবে সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফোর্ট বানাতে শুরু করেছে। তাঁদের অনুরোধে জয়নারায়ণ ঘোষাল সে অঞ্চল ছেড়ে খিদিরপুরে চলে আসেন। তৈরি করলেন বসতবাড়ি।

শিবমন্দিরের পাশেই রয়েছে ঘোষাল বংশের কূলদেবী পতিতপাবনী দুর্গার মন্দির। এক সময় গঙ্গার জল এসে নাকি মূর্তির পা ধুইয়ে দিয়ে যেত। আর সেই থেকে পতিতপাবনী নামের জন্ম হয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে দুটি কামান। পতিতপাবনী ছাড়াও রয়েছে মকরবাহিনী গঙ্গা, পঞ্চাননদেব, রাজরাজেশ্বরী ও মহাকালের মূর্তি। ১৭৮২ সালে জয়নারায়ণ ঘোষাল দিল্লির বাদশা মহম্মদ জাহান্দার শাহের কাছ থেকে মহারাজা বাহাদুর খেতাব পান। সে বছরেই বিশাল রাজপ্রাসাদের মধ্যে নির্মিত হয় কুলদেবী মা পতিতপাবনী দুর্গার মন্দির। গ্রিক, মুসলিম ও হিন্দু স্থাপত্য আঙ্গিকের মিশেলে দালান রীতিতে মন্দিরটি নির্মিত। মন্দিরটির অবস্থান এমন যেন কুলদেবী সরাসরি দেখতে পান পুষ্করিণীর পাশের শিবমন্দির এবং রাজপ্রাসাদ।মহারাজা কুলপুরোহিত নিযুক্ত করেছিলেন চণ্ডীচরণ পাঠককে। আজও তাঁর বংশধরেরাই পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন।

জয়নারায়ণ ঘোষালের অবদান শুধু মন্দির নির্মাণে নয়। ইসলামিক যুগের অন্ধকার কাটিয়ে শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা স্মরণযোগ্য। খ্রিস্টান ধর্মকে তিনি যথেষ্ট সম্মান করতেন। ১৭৮২ সালে সেন্ট জনস চার্চ তৈরির সময় তিনি পাঁচশ টাকা দান করেছিলেন, বাইবেল সোসাইটিকে দিয়েছিলেন একশ টাকা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে জয়নারায়ণ কাশী চলে যান, সম্পত্তি দেখাশোনার ভার তুলে দেন পুত্র কালীশংকর ঘোষালের হাতে। বাবা ও ছেলের যৌথ প্রচেষ্টা ছিল দেশে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের। মিশনারিদের সাথে মিলে তাঁরা তৈরি করেন স্কুল, যেখানে দেশের ছেলেদের ফার্সি, হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শেখানো হত। এই স্কুলের জন্য জয়নারায়ণ বরাদ্দ করেছিলেন চল্লিশ হাজার টাকা, যার থেকে মাসে দুশো টাকা করে স্কুলের খরচে ব্যয় করা হত। শুধু খিদিরপুরে নয়, বেনারসেও স্থাপন করেছিলেন স্কুল। আজও সেখানকার জয়নারায়ণ কলেজ তাঁর নামের স্মৃতি বহন করছে। খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন জয়নারায়ণ, তাঁর অসুখের সময় এক ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ী জি হুইটলি কিছু খ্রিস্টধর্মীয় তুকতাকে তাঁকে আরোগ্য দিয়েছিল। তবু তিনি আমৃত্যু নিজ ধর্ম ত্যাগ করেননি এবং তাঁর বিশাল ভূসম্পত্তি ইচ্ছাপত্রের মাধ্যমে দান করে যান দেবত্তর সম্পত্তি হিসেবে মা পতিতপাবনী দুর্গার নামে।

ফেরার পথে চোখে পড়ল ভগ্ন রাজবাড়ির একাংশ। অথচ এই রাজবাড়ি, সংলগ্ন পুকুর, মন্দির ইত্যাদি ১৯৯৬ সাল থেকেই কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন কতৃক হেরিটেজ তালিকাভুক্ত। মন্দের ভাল শিবগঙ্গায় বাসন মাজা ও কাপড় কাচা বন্ধ হয়েছে। শিবরাত্রির সময় এখানে এক মাস ব্যাপী অনুষ্ঠান ও মেলা বসে। এমনিতেও বিকেলের দিকে হনুমান চালিশা পাঠ, ভজন, কীর্তন সবই হয়।

আলো ঝলমল করলেই মনে হয় এ যেন ছোট্ট এক টুকরো বেনারস। সময় সুযোগ করে একদিন ঘুরে আসতেই পারেন। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া... এই একটুকরো ইতিহাস মন্দ লাগবে না।
নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।
বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।
ছবিঃ লেখকের নিজস্ব