ভারতবর্ষের সংস্কৃতি প্রায় হাজারও দেবদেবী দ্বারা সমৃদ্ধ । এখানে দেবতাদের আরাধনা করার জন্য প্রায় সর্বত্রই ছোট বড়ো মন্দিরের সমাহার চোখে পড়ে । এছাড়াও প্রতিটি মন্দিরের নিজস্ব কোনও না কোনও বৈশিষ্ট্য- যেমন মন্দিরটি স্থাপত্য শিল্পকলার থেকে দেব দেবীর পূজার্চনা কিংবা কোনও উৎসব থেকে শুরু করে মন্দিরে স্থাপিত দেবতাকে তুষ্ট করার রীতিনীতি রয়েছে। তবে এই ভারতের ভূমিতে এমন কিছু মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে যাকে রহস্যমণ্ডিত মন্দিরের উপাধি দেওয়া চলে ।
কী ভাবছেন একটু অবাক হচ্ছেন? চলুন ভারতের এই রহস্যমণ্ডিত মন্দির সম্পর্কে একটু বিশদে জেনে নেওয়া যাক ।
রাজস্থানের দৌসা জেলায় অবস্থিত এই মন্দিরটিতে মানুষ নিজেদেরকে ভূত, প্রেত অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করার প্রতিদিন আরাধ্য দেবতাকে অর্চনা করেন । এখানকার মানুষ ভূত তাড়ানো রীতির ক্ষেত্রে চরমপন্থী পন্থা অবলম্বন করেছেন । ভর করা মানুষটির উপর প্রথমে উষ্ণ গরম জল ঢালা হয়, এরপর দেওয়ালে শিকল দিয়ে বেঁধে উলম্বভাবে ঝুলিয়ে ঝাড়ুর সাহায্যে প্রহার এবং একই সাথে অনবরত তার মাথাটা দেওয়ালে আঘাত করা হয় । এই সমস্ত ঘটনা বালাজি মন্দিরের পুরোহিতের পরিচালনায় সম্পন্ন হয় । এই অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস এইভাবেই তারা অশুভ শক্তি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন ।
এই মন্দিরে কোনও প্রসাদের ব্যবস্থা নেই । এছাড়াও মন্দির থেকে প্রস্থানের সময় পুনঃবার মন্দির দর্শন করা নিষেধ, কারণ সেক্ষেত্রে আবার প্রেতের আক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায় ।
আসামের গুয়াহাটিতে অবস্থিত নীলাচল পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত কামাখ্যা দেবীর মন্দিরটি, ভারতের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম । এই মন্দিরে দেবীর কোনও মূর্তি নেই। মন্দিরের গর্ভগৃহে লাল কাপড়ে ঢাকা দেবীর যোনী এখানে পূজিত হয় । অম্বুবাচির উৎসবে দেবীর রজঃস্বলার সময় তিনদিন এই মন্দিরটি সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ থাকে । কথিত আছে এই সময় মাটির নিচের থেকে লাল বর্ণের জল নিঃসৃত হয় ।তাই ভক্তদের উৎসর্গ করা লাল কাপড় দিয়েই দেবীকে আবৃত করা হয় ।
মধ্যপ্রদেশের দেবজী মহারাজ মন্দিরে প্রতি মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পুজো করে ভূত বা অশুভ শক্তির হাত থেকে রেহাই পেতে দেবতা তুষ্ট করা হয় । চিরাচরিত প্রথা অনুসারে ভক্তরা শরীরে থাকা প্রেতকে তাড়ানোর জন্য হাতে কর্পূর জ্বালিয়ে দেবতাকে উপাসনা করেন । এছাড়াও এখানে ঝাড়ু পেটা করে ভূত তাড়ানোরও রীতি রয়েছে ।
তবে এখানকার অধিবাসীদের সবচেয়ে অদ্ভুত রীতি হলো ভূত মেলা । এই অঞ্চলে প্রতি বছর মন্দির সংলগ্ন প্রাঙ্গনে অশুভ শক্তি বিনাশের জন্য সাড়ম্বরে এই মেলার আয়োজন করা হয় ।
কেরালার এই মন্দিরে দেবী কালীর অন্যরূপে বিরাজিত আছেন। প্রকৃতপক্ষে কোদুঙ্গালুর মন্দিরে স্থাপিত আছেন দেবী ভদ্রকালী । প্রতিবছর এই মন্দির কে কেন্দ্র করে সাত দিন ব্যাপী একটি অদ্ভুত উৎসব পালন করা হয় যা ভারানী উৎসব নামে পরিচিত। এই উৎসবে পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ লাল পোশাকে রঞ্জিত হয়ে তরবারি নিয়ে মন্দির চত্বরে নিজেদের আঘাত করেন। এরা সকলেই তরবারির সাহায্যেএকে অপরের মাথায় আঘাত করে রক্ত ঝরান এবং মন্দিরে প্রবেশ করে ভগবানের উদ্দেশ্যে অশ্লীল গান করে ভগবানকে তুষ্ট করেন। এছাড়াও দেবতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মূর্তি এবং লাঠি ছোড়েন । এই ধ্বংসাত্মক উৎসব সম্পন্ন হওয়ার পর প্রায় সাতদিন এই মন্দির বন্ধ থাকে।
ভারতে অবস্থিত বেশিরভাগ মন্দির ভক্তদের অর্থদানের উপর কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, তবে এই এই মন্দিরের দানের রীতিটা কিছুটা অন্যরকম । এই ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে ভক্তরা ভগবানকে নিজেদের চুল উৎসর্গ করেন । এই মন্দিরের দুইটি বড়ো বড়ো হলঘর জুড়ে কর্মরত রয়েছেন অনেকজন নাপিত। এই মন্দিরে প্রতিদিন প্রায় ১২,০০০ দর্শণার্থীর সমাগম হয়, এবং তারাই দেবতা কে নিজেদের কেশ দান করেন । এই দান থেকে প্রতিবছর ৭৫টন চুল সংগ্রহ করে ইতালি, চিনে বিক্রি করে এই মন্দির ৬.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে ।
গুজরাটে অবস্থিত এই শিব মন্দিরটি বেশিরভাগ সময় আরব সাগরের জলের তলায় নিমজ্জিত থাকে। একমাত্র ভাঁটার সময়েই এই ভক্তরা এই মন্দির দর্শনের সুযোগ পান । কথিত আছে জলে নিমজ্জনের সময় যে ভক্ত একবার নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মন্দির দর্শন করে দেবতাকে আরাধনা করেছেন, তিনি ভগবান শিবের আশীর্বাদ পেয়েছেন ।
মুঘল সাম্রাজ্যের কালে সম্রাট ঔরঙ্গজেব ভারতের প্রায় সর্বত্র হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে দেন, কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে পুষ্করের এই ব্রহ্ম মন্দির ধ্বংস করতে তিনি অসমর্থ হন । তাই আজও অশুভ আগ্রাসন থেকে রক্ষার জন্য এই মন্দিরে ভগবান ব্রহ্মকে পূজা করা হয় । সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, হিন্দু পুরাণ অনুসারে সৃষ্টির আধার এই ব্রহ্মকে কেন্দ্র করে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এই একটাই মন্দির রয়েছে। এই মন্দির মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মিত, আবার মন্দিরের গর্ভগৃহের দেওয়াল রৌপ্য মুদ্রার সমন্বয়ে সজ্জিত রয়েছে এবং এই উৎসর্গ করা মুদ্রায় ভক্তদের নাম অঙ্কিত আছে ।
শিব অর্চনার জন্য পবিত্র ভূমি বরানসীতে অবস্থিত কাল ভৈরব মন্দিরে ভগবান শিব কাল ভৈরব রূপে পূজিত হন । এই মন্দিরে দেবতাকে হুইস্কি বা ওয়াইন জাতীয় সুরা দ্বারাই দেবতাকে আরাধনা করা হয়। ভারতের যেখানে মন্দিরগুলিতে ফুল মিষ্টান্ন দেবতাকে উৎসর্গ করা হয়, সেখানে এই মন্দিরে দেবতার মুখগহ্বরে সুরা ঢেলে পূজা করা হয় ।
অন্ধ্র প্রদেশের কুর্ণল জেলায় অবস্থিত দেবারগাট্টু মন্দিরটি বাণী উৎসবের জন্য বিখ্যাত ।প্রতি বছর দশেরার দিন সমস্ত মানুষ একত্রে জমায়েত হয়ে একে অপরকে লাঠি দ্বারা মাথায় আঘাত করেন ।কথিত আছে মালা - মাল্লেশ্বর অর্থাৎ ভগবান শিব এই দিনে দুষ্ট রাক্ষসকে হত্যা করেন । পুরানের সেই ঘটনাকে স্মরণে রেখেই ভক্তরা একে অপরকে আঘাত করে রক্তপাত ঘটান ।১০০ বছরের প্রাচীন এই উৎসবে আগে কুঠার বা তরবারির সাহায্যে পালিত হলেও বর্তমানে লাঠির সাহায্য নিয়েই এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। ২০১৪ সালের পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ৫৬ জন মানুষ এই উৎসবে আহত হয়েছিলেন। সমস্ত রকম সামরিক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও উৎসব চলাকালীন কারোর মধ্যস্থতার অনুমতি নেই।
বৃন্দাবনের এই নিধিবনের এর ধারণাটা বিশেষত কৃষ্ণকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে নিধিবন হল বৃন্দাবনের এক ঘন জঙ্গল। অবিশ্বাস্য বিষয় হল, এই বনের গাছ গুলি বছরের সবসময়ই সবুজ থাকে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় এই গাছ একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত, কিন্তু আদতে তা নয় । মনে করা হয় এই গাছ গুলি কৃষ্ণর গোপিনী । এছাড়াও কথিত আছে, সূর্য অস্তাগমনে গেলে কৃষ্ণ গোপিনীদের সাথে রাসলীলা খেলায় মত্ত হওয়ার জন্য এই মন্দিরে আসেন । অনেকে রাতের দিকে এখানে ঘুঙুরের আওয়াজও পেয়েছেন ।
বীরভদ্র মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৬শ শতকে । স্থানীয় অঞ্চলে এই মন্দিরটি লেপক্ষী মন্দির হিসেবে পরিচিত। তৎকালীন বিজয়নগর স্থাপত্য শিল্পকলায় গঠিত এই মন্দিরটিতে রয়েছে প্রায় ৭০টি বড় বড় স্তম্ভ । এর মধ্যে অনেক গুলি স্তম্ভ রয়েছে যেগুলি অন্যান্য স্তম্ভের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, অন্যদিকে এই স্তম্ভ গুলি মন্দিরের ছাদের অংশ থেকে ঝুলন্ত; আবার নিচের মেঝের সঙ্গে যুক্ত নয়। তবে দর্শণার্থীদের প্রবেশের জন্য প্রশস্ত জায়গাও রয়েছে । আপাতদৃষ্টিতে বিপজ্জনক মনে হলেও এখনও কোনও রকম বিপজ্জনক ঘটনা এখানে ঘটেনি ।
কী ব্লগটা পড়ে কি মনের মধ্যে কোনো রকম কৌতূহল জাগল? তাহলে আর দেরি না করে বেরিয়েই পড়ুন রহস্য সন্ধান করতে। আর হ্যাঁ, আমরা কিন্তু আপনার রহস্য সমাধানের অপেক্ষায় থাকলাম ।