কলকাতার চিনাপাড়াতে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি জেনে নিতে পারেন এখানকার অজানা কিছু কথা...

Tripoto
Photo of কলকাতার চিনাপাড়াতে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি জেনে নিতে পারেন এখানকার অজানা কিছু কথা... 1/1 by Aninda De
একটুকরো চিনে পাড়া (ছবি সংগৃহীত)

মধ্য কলকাতার লালবাজার অঞ্চলের পিছন দিকে লুকিয়ে রয়েছে একটুকরো চিনে পাড়া। ওল্ড চিনা মার্কেট নামে এককালে পরিচিত এই অঞ্চলে একসময় বসবাস করতেন প্রায় ২০০০০ হাজার ভারতীয় চীনারা। আজ সেই জনসংখ্যার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে, কেউ কেউ ফিরে গেছে চিনে, কেউ কেউ ভবিষ্যতের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায়। আবার শহরের ভিতরেই অনেকে উঠে গিয়ে বসবাস স্থাপন করেছেন ই.এম বাইপাসের ধারে ট্যাংরা অঞ্চলে। পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক দেশেই কিন্তু একটার বেশি চাইনাটাউনের হদিশ পাওয়া যায়। কলকাতা হচ্ছে সেইসব বিরল শহরগুলির মধ্যে অন্যতম, যেখানে ট্যাংরা আর টেরিটি মিলিয়ে রয়েছে দু-দুখানি চাইনাটাউন। আজ রইল টেরিটি বাজার, তার ইতিহাস আর সেখানের খাওয়া দাওয়ার গল্প।

টেরিটি বাজারের ইতিহাস

ভারতবর্ষের প্রথম চিনাপাড়া হল এই টেরিটি বাজার সংলগ্ন অঞ্চল। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে চিনের হাক্কা অঞ্চলের প্রচুর অধিবাসী ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবান্বিত দ্বিতীয় রাজধানী কলকাতার বুকে জীবিকা সঞ্চয়ের জন্যে তাঁরা সমুদ্রপথে এসেছিলেন এখানে। কথিত আছে এই বাজার অঞ্চলটির মালিক ছিলেন ইতালিয়ান এদুয়ার্ড তিরেত্তা। ক্যালেন্ডারে তখন ১৭৯০। তখন থেকেই আসতে আসতে এই এলাকার গোড়াপত্তন। আর তখন থেকে একনাগাড়ে প্রায় ২০০ বছর ধরে রমরমিয়ে চলে আসছে এই চৈনিক বাজারটি।

উনবিংশ শতকের মাঝে প্রচুর চৈনিক নাবিকরা কলকাতায় নেমে এখানে বেশ কিছুদিন থাকতেন। সেই সময়ে এইখানে গড়ে উঠেছিল প্রচুর আফিমের আড্ডা আর জুয়া খেলার আসর। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে তাই চাইনাটাউনের নামে ভুরু কোঁচকানোর উৎস হয়ত এই ইতিহাস থেকেই।

টেরিটি বাজারের খাবার দাবার

আসতে আসতে এই অঞ্চলে বসবাসকারী হাক্কা এবং ক্যান্টোনিজ চাইনিজরা নিজেদের মধ্যে বেশি করে মেলামেশা শুরু করেন। অনেক ভারতীয়দের সঙ্গেও বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন থেকেই খাবারের সঙ্গে এই এলাকার নাম জড়িয়ে পড়ে। বহু চাইনিজ পরিবার নানারকম খাদ্যদ্রব্য তৈরি করেন এবং তাঁরা দোকান দিতে শুরু করেন। শুরু হয় ব্রেকফাস্ট বা প্রাতরাশের সময়ে হরেক রকম খাবারের পসরা সাজিয়ে বসা।

বর্তমানে আপনি যদি ভোর ভোর টেরিটি বাজারে একবার এসে পড়তে পারেন, তাহলে দেখতে পাবেন চারিদিকে রয়েছে নানান খাবার দাবার। পর্কের পুর ভরা গরম তুলতুলে স্টিমড বান, গরম গরম মোমো - কোনটা ফ্রাই করা আবার কোনটা ভাপানো, আছে ডাম্পলিং, আছে সুইমাই, আছে ধোঁয়া ওঠা বাটিতে সুস্বাদু ফিশ বল স্যুপ। ইচ্ছে করলে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন কাঁচা চাইনিজ সসেজ কিনে। পেঁয়াজ, লঙ্কা আর সস দিয়ে কষিয়ে সেই সসেজের জুড়ি মেলা ভার। বহু শতকের বিবর্তনে টেরিটি বাজারের খাবার দাবার হয়ে উঠেছে একেবারে নিজস্ব গুণ সম্পন্ন। চাইনিজ হেরিটেজকে সঙ্গে রেখে কলকাতার স্বাদকোরককে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হয়েছে কলকাতা-চাইনিজ কুইজিন, যা পৃথিবীতে এই একটি জায়গাতেই পাওয়া যায়।

টেরিটি বাজারের ব্রেকফাস্টের সময়

প্রতিদিন ভোরবেলা ৫.৩০ থেকে ৭টার মধ্যে আপনি নানান রকম খাবার পাবেন। বেলা করে গেলে কিন্তু সব'ই ফুরিয়ে যায় এবং সেক্ষত্রে মন খারাপ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। রবিবারে কিন্তু প্রচুর পরিমাণে হকার এখানে দোকান দেন, তাই একসঙ্গে টেরিটি বাজারের সম্পূর্ণ মহিমাটি উপভোগ করতে চাইলে অন্যান্য দিনে না এসে রবিবারে আসাই শ্রেয়।

টেরিটি বাজারের রেস্টুরেন্ট

সকালে ঘুম থেকে ওঠা খুব কষ্টকর? ব্রেকফাস্টের সময় বাদে দিনের অন্যান্য সময়েও অথেন্টিক চাইনিজের খোঁজ চাই? চিন্তা নেই, টেরিটি বাজার সেই দিক থেকেও আপনার পাশেই আছে। এই অঞ্চলের রেস্টুরেন্টগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কম দামে অসাধারণ স্বাদের চাইনিজ খাবার পরিবেশন করা। হয়তো পাঁচ তারা হোটেলের বৈভব বা ঝাঁ চকচকে চেন রেস্টুরেন্টের চমক এখানে নেই। কিন্তু বহু প্রজন্মের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা জনপ্রিয় জায়গাগুলি স্বাদে গন্ধে মন জয় করে নেয় সকল স্বাদপ্রেমী খাদ্যরসিকের।

তুং নাম

একডাকে চেনা যায় মধ্য কলকাতায় এরকম একটি রেস্টুরেন্ট হল তুং নাম। দুপুর বেলা গেলে দেখতে পাবেন আসে পাশের অফিস পাড়ার বহু কর্মচারী অফিস থেকে ভ্যানিশ হয়ে এখানেই সেরে নিচ্ছেন লাঞ্চ। পর্ক প্রেমীদের কাছেও তুং নাম কলকাতার অন্যতম প্রিয় জায়গা।

কী কী খাবেন : স্টিমড ওয়ান্টন, ড্রাই চিলি পর্ক, ফিশ ইন হামেই সস, কাপ্তাই হ্যামচয় আর মিক্সড হাক্কা নুডলস...

পাও হিং

তুং নামের থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে রয়েছে পাও হিং। স্বাদে কোনও অংশে তুং নামের থেকে কম নয়, তবে মেনুতে পর্ক না থাকার কারণে ভিড়টাও একটু কম হয়। কোনও কারণে তুং নাম খোলা না থাকলে, নিশ্চিন্তে চলে আসুন পাও হিং। এত অল্প দামে এতটা সুস্বাদু খাবার শহর কলকাতায় আর বেশি পাওয়া যায় না।

কী কী খাবেন : ভলক্যানো চিকেন, ড্রিংকিং উইংস, প্ৰণ হট গার্লিক সস, চিলি ফিশ আর মিক্সড সেজওয়ান ফ্রায়েড রাইস

সেই ভুই

টেরিটি বাজারের নবতম সংযোজন সেই ভুই রেস্টুরেন্ট। এই অঞ্চলের একটি বহু পুরনো বাড়ি সংস্কারের পরে তার ভিতরে গড়ে উঠেছে এই নতুন রেস্টুরেন্টটি। চিনে পাড়ার চেনা খাবার আরেকটু চকচকে এমবিয়েন্স-এর মধ্যে পরিবেশন করাই সেই ভুইয়ের প্রাথমিক লক্ষ্য।

কী কী খাবেন : লাট মে কাই চিকেন, ভিয়েতনামিজ রাইস পেপার রোল, খাও সুয়ে, স্কুইড ইন ওয়েস্টার সস , ক্র্যাব ইন ব্ল্যাক বিন সস। সঙ্গে রয়েছে নানান রকম নুডলস আর রাইস।

ডি'লে

এই অঞ্চলের আরেকটি নামকরা দোকান হল ডি'লে। দেখতে ছোট্টখাট্ট হলেও, ডি'লের খাবারের গুনগ্রাহী গোটা শহর জুড়ে। তুং নামের মতো, এঁদেরও পর্ক স্পেশালিটি গুলি খুব'ই জনপ্রিয়। বড় অর্ডার দিলে আপনার চাহিদা মতো মেনুর বাইরের বিভিন্ন ডিশ বাড়ির মতন করে এনারা তৈরি করে দেন।

কী কী খাবেন : সুইট অ্যান্ড সাওয়ার পর্ক, সসেজ কারি, ফ্রায়েড প্ৰণ বলস, চিলি চিকেন, হট গার্লিক ফিশ, হৈ সিন প্ৰণ এবং এগ ফ্রায়েড মেই ফুন নুডলস।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।