কলকাতার মধ্যে রয়েছে বদলে যাওয়া সময়ের ইতিবৃত্ত

Tripoto
Photo of কলকাতার মধ্যে রয়েছে বদলে যাওয়া সময়ের ইতিবৃত্ত 1/2 by Surjatapa Adak

প্রত্যেকটা বাঙালির প্রাণের শহর হল কলকাতা । এককথায় বলা যেতে পারে এই শহর ছাড়া কফি হাউসের আড্ডা থেকে ময়দানে প্রেম, সমস্তটাই মূল্যহীন। তাই নয় কি? চলুন একটু সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক কীভাবে বাংলার এই রাজধানীর শহরের জন্ম ।

কলকাতা শহরের উৎপত্তি -

১৬শ শতকের থেকে ১৮শ শতক কলিকাতা , সুতানুটি এবং গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রাম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৬৯০ সালে ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় আসে এবং বাংলায় তাদের বাণিজ্যিক আধিপত্য গড়ে তোলে। সেই সময় এই কোম্পানির প্রশাসনের দায়িত্বভারে নিযুক্ত ছিলেন জব চার্ণক। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে এই জব চার্ণক হলেন কলকাতা শহরের রূপকার।

Photo of কলকাতার মধ্যে রয়েছে বদলে যাওয়া সময়ের ইতিবৃত্ত 2/2 by Surjatapa Adak

কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের ৭৪ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর ও এই শহরের ইতি -উতি রয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ পরশ। বাহ্যিক দর্শনে আধুনিকতার পরিমণ্ডলে শহরের উপরিভাগ গঠিত হলেও এর অভ্যন্তরে রয়েছে অনেক জানা অজানা ইতিহাস।

কলকাতার কিছু বিখ্যাত রাস্তা ও এলাকার ইতিকথা -

১. পার্ক স্ট্রিট -

Photo of Park Street, Mullick Bazar, Beniapukur, Kolkata, West Bengal, India by Surjatapa Adak

কলকাতা শহরের মুখ্য অঞ্চল বলতে যে জায়গাটিকে বোঝায়, সেটি হল পার্ক স্ট্রিট। খ্র্রিস্টমাস থেকে নতুন বছরের সূচনায় তিলোত্তমাকে আলোকিত করার প্রধান অংশীদার এই স্থানটি একসময় মাদার টেরেসা সরণী হিসেবে পরিচিত ছিল।

১৭৭৩ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত সময়ে কলকাতায় অবস্থিত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন স্যার এলিজাহ। কলকাতায় থাকাকালীন এই অঞ্চলে তিনি একটি ডিয়ার পার্ক তৈরি করেন । পরবর্তীকালে এই ডিয়ার পার্কের নাম অনুসারেই এই অঞ্চলটি পার্ক স্ট্রিট নামে পরিচিত পায় ।

২. ক্যামাক স্ট্রিট -

Photo of Camac Street, Elgin, Kolkata, West Bengal, India by Surjatapa Adak

পার্ক স্ট্রিট এবং আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোডের সংযোগকারী স্ট্রিটটি ক্যামাক স্ট্রিট নামে পরিচিত । কিন্তু আপনি কি জানেন এই নামকরণের কারণ কী?

ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ এবং লর্ড ওয়েলেসলির সময়কালে, একজন বিত্তবান ব্যবসায়ী উইলিয়াম ক্যামাক কম খরচে ভারতীয় দ্রব্য কিনে, সেই দ্রব্য ব্রিটেনে বিক্রি করে প্রচুর টাকা উপার্জন করেন। পরবর্তীকালে এই বিত্তশালী বণিকের নাম অনুসারেই এই স্থানটিকে ক্যামাক স্ট্রিট নামে অভিহিত করা হয় ।

৩. চৌরঙ্গী রোড -

Photo of Chowringhee, NH 6, West Bengal, India by Surjatapa Adak

কলকাতা ইতিহাসের পাতাগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করলে জানা যায় ১৭শ শতকে ময়দান এবং এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত অঞ্চল ঘন জঙ্গলে আবৃত ছিল । শোনা যায় ওয়ারেন হেস্টিং এখানে হাতি চেপে শিকার করতে আসতেন । তর্কবিতর্ক থাকলেও অনেকেই মনে করেন চৌরঙ্গী রোড ব্রিটিশরাই নির্মাণ করেন। কথিত আছে এই অঞ্চলে চৌরঙ্গীনাথ নামে হিন্দু সাধুর ডেরা ছিল। আর তাই পরবর্তীকালে এই রোডটি চৌরঙ্গী রোড নামে পরিচিত পায়।

৪. হেয়ার স্ট্রিট -

Photo of Hare Street, Fairley Place, B.B.D. Bagh, Kolkata, West Bengal, India by Surjatapa Adak

কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট এবং নেতাজী সুভাষ রোডের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হেয়ার স্ট্রিট। এই স্ট্রিটটি নির্মাণ করেন লোটারি কমিটি। তাহলে আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন এই নামকরণের কারণ কী, তাই তো? ১৭৭৫ সালে ডেভিড হেয়ার নামক একজন স্কটিশ শিক্ষাবিদ ভারতে আসেন। সেই সময় তিনি এই অঞ্চলের নিক্কো হাউসে বসবাস করতেন এবং ডেভিড হেয়ারের নাম অনুসারেই এই স্ট্রিটটিকে হেয়ার স্ট্রিট নামকরণ করা হয়।

৫. রেড রোড -

Photo of Red Road, Maidan, Fort William, Hastings, Kolkata, West Bengal, India by Surjatapa Adak

ইডেন গার্ডেন এবং ফোর্ট উইলিয়ামের পশ্চিমের গেটের সংযোগকারী পথটি রেড রোড বা ইন্দিরা গান্ধী সরনী নামে পরিচিত। এই প্রশস্ত পথটি ১৮২০ সালে নির্মাণ করা হয়। ব্রিটিশদের এই প্রশস্ত পথ নির্মাণের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পতাকা উত্তোলন এবং প্যারেড প্রদর্শন ।

৬. শেক্সপীয়ার সরনী -

Photo of Shakespeare Sarani Road, Elgin, Kolkata, West Bengal, India by Surjatapa Adak

শেক্সপীয়ার সরনী বা থিয়েটার রোড অঞ্চলে ১৮১৩ সালে কলকাতা থিয়েটার নির্মাণ করা হয়। সেই সময় গিরিশচন্দ্র ঘোষের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা এখানে আসতেন । প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই ব্যক্তিত্বদের হাত ধরেই বাংলা নাট্যজগতের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে যদিও থিয়েটারটি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়।

এই কলকাতা থিয়েটারেরকে স্মরণে রেখেই এই পথের নামকরণ হয় থিয়েটার রোড। তবে ১৯৬৪ সালে বিখ্যাত নাট্যরচয়িতা শেক্সপীয়ারের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই এই থিয়েটার রোডের নাম পরিবর্তন করে শেক্সপীয়ার সরনী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ।

৭. স্ট্যান্ড রোড -

Photo of Strand Road, Jorabagan, Kolkata, West Bengal, India by Surjatapa Adak

হাওড়া ব্রিজের প্রান্ত ভাগ থেকে প্রিন্সেপ ঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ পথটি স্ট্যান্ড রোড নামে পরিচিত। ১৮২৮ সালে লোটারি কমিটির সাহচর্যে এই পথটি নির্মাণ করা হয় । বিখ্যাত ঐতিহাসিক এইচ. ই. এ. কটন এর মতানুসারে এই রোড হাটখোলা ঘাট থেকে প্রিন্সেপ ঘাট অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ।

৮. ধর্মতলা -

Photo of Dharmatala, Taltala, Kolkata, West Bengal, India by Surjatapa Adak

একদা এসপ্ল্যানেড থেকে ধর্মতলা অঞ্চল জুড়ে বহু ধর্মপ্রাণ মানুষ বসবাস করতেন । অধিকাংশ মানুষ মনে করেন একসময় এখানে ধর্ম ঠাকুরের আশ্রম ছিল,প্রধানত হরিশ এবং ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ এই ভগবানের শিষ্য ছিলেন । আর এই ধর্মঠাকুরকে অনুসরণ করেই এই অঞ্চলটি ধর্মতলা নামে অভিহিত করা হয় । তবে বোম্বে গ্যাজেট অনুসারে পূর্বে এই অঞ্চলটি ওয়েলিংটন নামে প্রচলিত ছিল ।

৯. বিবাদী বাগ -

Photo of B.B.D. Bagh, Kolkata, West Bengal, India by Surjatapa Adak

অফিস টাইমে ব্যাস্ততম পথ গুলির মধ্যে অন্যতম হলো বিবাদী বাগ। পূর্বে, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনকালে এই অঞ্চলটি ডালহৌসি নামে পরিচিত ছিল । পরবর্তী কালে, বিনয়, বাদল, দীনেশের মতো হাজারও তরুণ বিপ্লবীরা ইংরেজ শাসনের স্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধে মুক্তির জন্য লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। দেশের স্বাধীনতার রক্ষার্থে এই তিনজন বিপ্লবীকে ইংরেজ পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেন । এই তরুণ বিপ্লবীদের আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এই পথটি বিবাদী বাগ নামে অভিসিক্ত করা হয় ।

১০. এজরা স্ট্রিট -

Photo of Ezra Street, Chitpur, Barabazar Market, Kolkata, West Bengal, India by Surjatapa Adak

ব্রাবোর্ন রোড এবং রবীন্দ্র সরনীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের পথটি এজরা স্ট্রিট নামে পরিচিত। একদা বিত্তবান ইহুদি পরিবারের সদস্য ডেভিড এবং ইলা এজরা এই অঞ্চলেই বসবাস করতেন । ব্রিটিশ শাসনকালে এই দম্পতি মেয়েদের শিক্ষা প্রসারের জন্য এই অঞ্চলে একটি স্কুল নির্মাণ করেন । এছাড়াও কলকাতা শহরের বুকে পরিকল্পনা মাফিক আবাসন যেমন এসপ্ল্যানেড ম্যানশন এবং চৌরঙ্গী ম্যানশন নির্মাণ করেন । সেই কারণেই পরবর্তী কালে এই অঞ্চলটি এজরা স্ট্রিট নামে পরিচয় পায় ।

কলকাতা শহরের বিখ্যাত রাস্তাগুলির ইতিকথার অজানা কাহিনি কতটা উদ্দীপনাময় হল আমাদের লিখে জানান। আর আপনাদেরও যদি কলকাতার অজানা ইতিহাস সম্পর্কে আরও তথ্য জানা থাকে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে একদম ভুলবেন না ।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।