রাজস্থান বলতে আমরা কি বুঝি - উদয়পুর, জয়পুর, যোধপুরের মতন প্রাচীন ও রাজসিক দুর্গশহর - উটের পিঠে উঠে মরুভূমির উপর দিয়ে সাফারি, নাকি ভয়াল বিভীষিকাময় আতঙ্কের হাতছানি? কি, চমকে গেলেন তো? আসলে রাজস্থানের আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে এমন অনেক কুখ্যাত, অভিশপ্ত এবং রহস্যময় জায়গা, যা যুগে যুগে পর্যটকদের একসঙ্গে আতঙ্কিত এবং আকর্ষিত করে তুলেছে। ভাঙ্গর বা কুলধারার মতন, কিরাদুও ঠিক এমনই এক জায়গা।
থর মরুভূমির কাছে, রাজস্থানের বারমের নামক স্থানের কাছে অবস্থিত কিরাদু নামের মফস্বলি টাউন। কিরাদুতে আছে পাঁচটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, মনে করা হয় মন্দিরগুলির স্থাপনা একাদশ শতকের কোনও এক সময়ে। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা আছে রতিক্রিয়ার বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি। এই কারণে মন্দিরটিকে রাজস্থানের খাজুরাহ বলে অভিহিত করা হয়।
এই কিরাদুর মন্দিরগুলির সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে আর এক প্রাচীন অভিশাপের গল্প। মনে করা হয় কেউ যদি সূর্য নামার পরে কেউ যদি কেউ এখানে থাকে তাহলে তাদের শরীর পাথরে পরিণত হবে। তাই সূর্যাস্তের পরে মন্দিরের ত্রিসীমানায় কাউকে দেখা যায় না, বন্ধ দরজা দিয়ে যাতায়াতও করে না কেউ। দিনের বেলাতেও মন্দিরে ঢোকার জন্যে ব্যবহার হয় পাশের ছোট্ট দরজাটি, মেন গেট থাকে সবসময় বন্ধ।
ইতিহাস অনুযায়ী কিরাদু ষষ্ঠ শতাব্দীতে পরিচিত ছিল কিরাদ রাজপুতদের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল রূপে, কিরাদকোট নামে। কিরাদ রাজ্যের অধিবাসীরা ছিলেন ভগবান শিবের উপাসক, সেই থেকেই এই গ্রামে শিবমন্দিরের স্থাপনা এবং পুজোর সূচনা।
দ্বাদশ শতাব্দীতে পারমার বংশের সম্রাট সোমেশ্বর ক্ষমতায় আসেন এবং তখন থেকেই কিরাদুর গল্পে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। তুরস্ক দস্যুদের আক্রমণের হাতে কিরাদু বার বার পড়তে থাকে এই সময়। সাম্রাজ্যটিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এক প্রবীণ ঋষি পুরুষের শরণাপন্ন হন সোমেশ্বর এবং সেই ঋষির পরামর্শে এবং আশীর্বাদে তুর্কি দস্যুদের প্রতিহত করা হয়। কিছু সময় পরে সেই ঋষি নিজের শিষ্যকে সোমেশ্বর এবং তাঁর মন্ত্রী পরিষদের কাছে রেখে অন্য দেশে যান। তাঁর আদেশ ছিল শিষ্যকে যাতে যত্নসহকারে রাখা হয় সোমেশ্বরের রাজ্যে। কিন্তু কালের নিয়মে এবং সাম্রাজ্যের কূটকচালিতে ব্যস্ত হয়ে রাজ্যসভার সদস্যরা মুনির সেই শিষ্যের ভরণপোষণের প্রতি উদাসীন হয়ে ওঠেন।
অনাদরের কারণে শিষ্যটির অচিরেই শরীর খারাপ হয় এবং স্থানীয় এক গ্রামীণ মহিলা ব্যতীত আর কেউ তার খেয়াল রাখেনি। প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর শিষ্যের এই অবস্থা দেখে ঋষিপুরুষটি প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হন এবং কথিত আছে তখনই তিনি সমগ্র কিরাদুর উপরে অভিশাপ দেন। তিনি বলেন যে কিরাদকোট রাজ্যের সমস্ত অধিবাসী তাদের মনুষ্যত্বের অভাবে পাথরে পরিণত হবে। যে গ্রামীণ মহিলাটি শিষ্যের খেয়াল রেখেছিলেন, তাঁকে তিনি বলেন এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে এবং যাওয়ার সময় পিছন ফিরে না তাকাতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে তিনি পিছনে ফিরে তাকান এবং সঙ্গে সঙ্গেই পাথরে পরিণত হন।
এই কাহিনির প্রভাবেই এখনও কিরাদুর মন্দিরে সন্ধ্যার পর কোনও পর্যটকদের দেখা যায় না। কিন্তু তাও বহু বছর ধরে দিনের বেলা প্রচুর পর্যটক ভিড় করে আসেন কিরাদুর রহস্যের গহীনে পৌঁছে যেতে। আপনিও চেষ্টা করবেন নাকি, কিরাদুর মন্দিরে সন্ধ্যার পর এক রাত কাটাতে?