ছোট্ট শহর মংপুর গল্প... প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের এক সমীকরণ

Tripoto
15th Oct 2020

পাহাড়ঘেরা ছোট শহর মংপু (ছবি সৌজন্যে : শাশ্বতপ)

Photo of Mangpu, West Bengal, India by Never ending footsteps

পাহাড়প্রেমী বাঙালিদের জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা হল দার্জিলিং। দার্জিলিং শব্দটি এসেছে তিব্বতি শব্দ থেকে। তিব্বতি শব্দ ‘দোর্জে’ যার অর্থ হল (হিন্দু দেবতা ইন্দ্রের 'বজ্রদণ্ড'), অন্যদিকে ‘লিং’ শব্দের অর্থ হল 'স্থান'। এই দুই মিলিয়েই দার্জিলিং। দার্জিলিং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কম-বেশি সব বাঙালিরই রয়েছে। বাঙালি শব্দের প্রতি জোড় দেওয়ার কারণ হচ্ছে, ভ্রমণপ্রেমী বাঙালিদের অনেকেই বলে থাকেন ‘দীপুদা’ প্রেমী অর্থাৎ দীঘা, পুরী, দার্জিলিং- প্রেমী... কোথাও কখনও ছুটি পেলেই বা কখনও শুধুমাত্র হুজুগের বশেই বাঙালি বেরিয়ে পড়ে এই দীপুদা-র সন্ধানে।

কাজেই দার্জিলিং-র সঙ্গে বাঙালির একাত্মতার কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। এই দার্জিলিং-র একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র হল মংপু। পাহাড়ঘেরা, নিরবিচ্ছিন্ন সৌন্দর্যের আভরণে ভরপুর, মংপুর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল এর অবিচ্ছিন্ন শান্ত-শীতল-নীরব পরিবেশ। নীরবতায় ভরপুর এই শহরটি জুড়ে কেউ যেন চায়ের বাগিচা, ক্যালাইডোস্কোপ অর্কিড (দূর থেকে জলছবির মতোও লাগতে পারে) এবং সিঙ্কোনা গাছের এক অপরূপ প্যাচওয়ার্ক করে রেখে গেছে। মাথার উপরে ঘন নীল আকাশ, তার মধ্যে ভেসে বেরানো সাদা মেঘের ভেলা। প্রকৃতি যেন এক্ষেত্রেও তাঁর অকৃপণ সৌন্দর্যের ছোঁয়াটুকু ছড়িয়ে দিয়েছে। দার্জিলিং ভ্রমণের তালিকা প্রস্তুত করতে গিয়ে অনেক পর্যটকেরই তালিকা থেকে সবুজে ঘেরা, প্রকৃতির বৈচিত্রে ভরা ছোট্ট এই শহরটি ব্রাত্য থেকে যায়। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, এই মংপু শহর জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালির সেন্টিমেন্টের কথা। রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত, নোবেলপ্রাপক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচিহ্ন। বাঙালি সংস্কৃতির পরিপূর্ণতা তো একঅর্থে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর জীবনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত, কাজেই মংপুর এই স্মৃতিও বাঙালিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করবে এমনটা বলাটা ভুল হবে না। দার্জিলিং থেকে এক ঘণ্টা দূরে, মংপু শহর। মংপু শহর ঘুরতে গেলে অনেকেই অনেকেই রবীন্দ্র-স্মৃতিবিজড়িত ‘রবীন্দ্রভবন’ পরিদর্শন করে থাকেন। মৈত্রেয়ী দেবীর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইটি থেকে জানা যায় মৈত্রেয়ী দেবী এবং তাঁর স্বামী ডা. মনমোহন সেনের আতিথেয়তায় রবীন্দ্রনাথ প্রায় চারবার এই মংপুতে এসেছিলেন। মুগ্ধ হয়েছিলেন মংপুর সৌন্দর্যে। প্রকৃতির পূজারী রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং ভাললাগার কথাও স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্যে। কাব্যে। উপন্যাসে। ‘জন্মদিন’-সহ বেশ কিছু গান ও কবিতা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এই মংপুতে বসেই।

মংপু কেন যাবেন?

পাহাড়ি গাছপালা ঘেরা প্রকৃতির নিদারুণ সৌন্দর্য ( ছবি সৌজন্যে : সোনালিকা দেবনাথ)

Photo of ছোট্ট শহর মংপুর গল্প... প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের এক সমীকরণ by Never ending footsteps

যারা প্রকৃতিপ্রেমী, একইসঙ্গে ভ্রমণপ্রেমী তাদের কাছে আলাদা করে এই কেন-র কোনও উত্তর বোধহয় হয় না। কিন্তু মংপুর সৌন্দর্যই মিশে রয়েছে এর প্রতিটি পরতে পরতে। দার্জিলিং থেকে মংপু পর্যন্ত বাঁকানো যে রাস্তাটা চলেছে, সেই রাস্তা বরাবর যেতে যেতেই চা বাগানগুলির নিখাদ সৌন্দর্য আপনি দু'চোখ ভরে উপভোগ করতে পারবেন। সবুজঘেরা চা-বাগানের স্নিগ্ধতা মনকে করবে শান্ত। প্রকৃতিস্থ। প্রতিদিনের ব্যস্ততার দৌড়ে যে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের একাত্ম ব্যক্তিগত সম্পর্কটুকু গড়ে উঠতে পারে না। সেই সম্পর্ক যেন একটু একটু করে গড়ে উঠতে থাকে, এই পথ চলার বাঁকে বাঁকে। বলে রাখা ভাল, চা-বাগানের সৌন্দর্যতেই শুধুমাত্র নয়, আপনি মুগ্ধ হবেন, পাহাড়ি অর্কিড আর নাম-না জানা পাহাড়ি ফুলের রঙিন সৌন্দর্যে। দার্জিলিং থেকে ঘুম পাহাড় হয়ে তিস্তা বাজার, কিংবা বলা ভাল, কালিম্পং যাওয়ার পথে 'সাড়ে ছ-মাইল' গ্রাম থেকে ক্রমশ নিচের দিকে নামতে নামতে সতেরো কিলোমিটার দক্ষিণে ছোট্ট শহর মংপু অবস্থিত।

পাহাড়ি অর্কিডের অকৃপণ ছোঁয়া ( ছবি সৌজন্যে : জিহান এক্সহিন)

Photo of ছোট্ট শহর মংপুর গল্প... প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের এক সমীকরণ by Never ending footsteps

পাহাড়ি সৌন্দর্যে মোহিত না হলেও মংপু এই ছোট্ট শহরটির রয়েছে একধরনের ঐতিহাসিক আভিজাত্য। ঐতিহ্য। ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে প্রথম মংপুতেই সিঙ্কোনা গাছের চাষ-আবাদ শুরু হয়। এই সিঙ্কোনা কুইনাইন নামক বহুমূল্য ওষুধ প্রস্তুত করতে ঠিক কতখানি কার্যকরী তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। এই প্রসঙ্গে একটি তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে, মুংপুর প্রথম কুইনাইন কারখানাটি তৈরি হয় ১৮৬৪ সালে। কৃত্রিম কুইনাইন আসার আগে এই শহরের মানুষদের অনেকেই সিঙ্কোনা বাগানের উপরে নির্ভরশীল ছিলেন। কৃত্রিম কুইনাইন আসার আগে মূলত সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকেই প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান বের করে নিয়ে ওষুধ প্রস্তুত করা হত। এছাড়াও, মংপু ‘সিম্বিডিয়াম অর্কিড পার্ক’ হল একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রায় দেড়শোরও বেশি অর্কিড রয়েছে এখানে। বিভিন্ন প্রজাতির এই অর্কিডের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক এমনটা বলা যায়।

শান্ত সৌম্য দৃষ্টি.... (ছবি সৌজন্যে : দাননি পোস্টমা)

Photo of ছোট্ট শহর মংপুর গল্প... প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের এক সমীকরণ by Never ending footsteps

প্রকৃতির এমন সৌন্দর্যে মুগ্ধ নীরব দর্শক থাকতে থাকতে, আপনি যদি পশ্চিমে কোলে ঢলে পড়া ঈষৎ সূর্যাস্তের আভায় প্রকৃতির স্বরূপটুকু অন্বেষণ করতে চান, তবে কালীঝোড়া জলপ্রপাতের দিকে অবশ্যই যেতে পারে। ৫৫০ ফুটে প্রবাহিত, এর জলরাশি মহানন্দা বন্যজীবন অভয়ারণ্যের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এবং গিয়ে মিশেছে তিস্তার সঙ্গে। একদিকে অভয়ারণ্য, অন্যদিকে জলপ্রপাতে জলরাশির মুগ্ধতা- এমন যুগ্ম সহবস্থান সত্যিই মনোমুগ্ধকর।

প্রকৃতির এই সরল স্নিগ্ধ রূপের সঙ্গে মিশে গিয়েছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অন্তর্লীন বাণী। তাঁদের স্তবস্তোত্রমালা। মন্ত্রোচ্চারণের প্রতিধ্বনি যেন পাহাড়ে পাহাড়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন। স্নিগ্ধ এই রূপের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে ‘ডিনচেন শেরাপ ছোয়েলিং গোম্পা’ দেখতে পারেন। শান্তি চক, মঠটির শান্তিপূর্ণ প্রাঙ্গণও আপনার অন্তরাত্মাকে পরিতৃপ্ত করতে বাধ্য। কর্মবহুল জীবনেরও যে একটা বিপরীত অভিমুখ রয়েছে আপনি তা সহজেই অনুভব করতে শিখবেন। সঙ্গে বৌদ্ধসন্ন্যাসীদের মৃদু, শান্ত, সৌম্যদৃষ্টিভঙ্গি আপনার জীবন ভ্রমণ পথের পরিচায়ক হয়ে উঠতে পারে। জীবনের যাবতীয় গ্লানি সাময়িকভাবেও নিবৃত্তি পেতে পারে এই সূত্রে।

ছবি সৌজন্যে : এভগ্যানি জিভাগো

Photo of ছোট্ট শহর মংপুর গল্প... প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের এক সমীকরণ by Never ending footsteps

দার্জিলিং-র ছোট্ট এই মংপু শহরটি সম্পর্কে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের ইতিবৃত্ত আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বিশেষ করে ‘রবীন্দ্রভবন’-সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রভবন-টি কাচের দরজা-জানালা সম্বলিত সাদা রঙের। প্রবেশপথের একেবারে বাঁদিকে চোখে পড়বে কবিমূর্তি। আর সবুজের লন পেরিয়ে লম্বা টানা বারান্দা নিয়ে যাবে বিগত কোনও অতীতে... বারান্দাতে পৌঁছেই চোখে পড়বে একটি আরামকেদারা, সেখানেও কবিপ্রতিকৃতি স্ব-মহিমায় ভাস্বর। এই বাড়িকে ঘিরে রয়েছে না বলা কত ইতিহাস, রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, পান্ডুলিপি। বলাবাহুল্য অত্যন্ত যত্নসহকারেই সকল বিষয়েরই সংরক্ষণ করা হয়েছে এক্ষেত্রে। প্রসঙ্গক্রমে অবশ্যই বলতে হবে বহু বছরের পুরনো ‘সপ্তপর্ণী’ গাছটি এই বাড়ি ঘিরে আজও স্ব-প্রকাশিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সময়ে মংপু ভ্রমণ করেছিলেন, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাও উন্নত ছিল না, কাজেই পালকির মাধ্যমেই তিনি মংপু যাতায়াত করতেন। সাহিত্য অনুরাগী পর্যটকদের এই রবীন্দ্রভ্রমণ ঘুরে দেখাতে সাহায্য করবেন, সেই নেপালি পালকি বাহকদেরই একজন উত্তরসূরি।

মংপুর স্পেশ্যাল থুকপা ( ছবি সৌজন্যে : অশ্বিন কুমার)

Photo of ছোট্ট শহর মংপুর গল্প... প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের এক সমীকরণ by Never ending footsteps

মংপুর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বাস করেন যেমন- বাঙালি, নেপালি, তিব্বতি এবং ক্যাথলিক। কাজেই ধর্ম এবং জাতিগত সংস্কৃতি সমন্বয়ের পাশাপাশি খাদ্যাভাসেও রয়েছে পর্যাপ্ত বৈচিত্র। সুস্বাদু স্টিম্পড ডাম্পলিংস (মোমো) থেকে সর্বাধিক সুগন্ধযুক্ত তিব্বতি নুডল স্যুপ (থুকপা) এখানে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবারের মধ্যে পড়ে।

কখন যেতে হবে

ছবি সৌজন্যে : মারলা অ্যাঞ্জেলোভা

Photo of ছোট্ট শহর মংপুর গল্প... প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের এক সমীকরণ by Never ending footsteps

মুংপু ভ্রমণের আদর্শ সময়টি জুন মাসের মধ্যে এবং অক্টোবরের মধ্যে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সেই মাসগুলিতে যখন তাপমাত্রা মোটামুটি কম থাকে এবং সিঙ্কোনা গাছেও ফুল আসতে শুরু করে। মংপু দার্জিলিং থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। এছাড়াও রামবি বাজারের কাছাকাছি অবস্থিত পেশোক রোড বা সিকিম বেঙ্গল ন্যাশনাল হাইওয়ে 31Aএর মাধ্যমে ব্যবহারও করতে পারেন।

যাতায়াত ব্যবস্থা

নিকটতম বিমানবন্দরটি বাগডোগরায় অবস্থিত। নিকটতম রেলস্টেশনটি নিউ জলপাইগুড়িতে, এটি দুই কিলোমিটার দূরে রয়েছে। মুংপুতে স্থানীয় ট্যাক্সিগুলি আপনি উভয় থেকেই ব্যবহার করতে পারবেন। ছোট্ট এই শহরটি ঘুরে দেখতে অবশ্যই আপনি রিকশা, অটোরিকশা, বাস এবং স্থানীয় ট্যাক্সিগুলি ব্যবহার করতে পারেন।

থাকার ব্যবস্থা

ছায়া ঘেরা শান্তির নীড়... (ছবি সৌজন্যে : আইরবনব)

Photo of ছোট্ট শহর মংপুর গল্প... প্রকৃতি আর ঐতিহ্যের এক সমীকরণ by Never ending footsteps

মংপুতে থাকার ব্যবস্থা এখনও সেই পরিমাণে উন্নত বা পর্যাপ্ত নয় কিন্তু এখানকার স্থানীয়েরা অত্যন্ত ভাল। আন্তরিক। তাঁরা আপনাদের এক-দুইদিনের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন. এছাড়াও থাকার জন্য দেখতে পারেন Runglee Rungliot Tea Factory।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যাবহার করুন

(এটি একটি অনুবাদকৃত / অনুলিখিত আর্টিকেল। আসল আর্টিকেল পড়তে এখানে ক্লিক করুন!)